যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে  যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলের অভিযোগ

 

নিজস্ব প্রতিবেদক :

রাজধানীর পূর্ব শেওড়াপাড়ায় যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোবারক হোসেন সরকারের বাড়ির একাংশ দখল করে নিয়েছে অবৈধ দখলদাররা। বাড়াবাড়ি করলে প্রাণনাশেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে। আর তাই এখন ভয়ে মূল বাড়ি থেকেও বের হচ্ছে না ওই পরিবারের সদস্যরা। এতে ওই মুক্তিযোদ্ধার স্কুলপড়ুয়া নাতির পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে।

কাফরুল থানা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে ওই জমি দখল করা হয় বলে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের অভিযোগ। ৯০৬/৩ নম্বরের ওই বাড়ি উদ্ধারে কাফরুল থানার পুলিশের সহযোগিতা চাইলেও পুলিশ প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে জানিয়েছে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার।

মুক্তিযোদ্ধার পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মোবারক হোসেনের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার ঘুষিঙ্গা ইউনিয়নে। তিনি প্রায় ৩৫ বছর ধরে সৌদি আরবে বসবাস করছেন। ১৯৮৭ সালের ২৫ জুন রাজধানীর কাফরুল থানার সেনপাড়া পর্বতা মৌজায় আরএস ১২৫৬ নম্বর দাগের পাঁচ কাঠার ওই জমিটি কেনে তাঁর পরিবার।

৮৮৬৭ নম্বর দলিলের মাধ্যমে স্থানীয় মিজান চৌধুরীর দুই ছেলে সেলিম রেজা ও আনিসুর রহমানের কাছ থেকে চার কাঠা এবং ২৫৬৪ নম্বর দলিলের মাধ্যমে আরো এক কাঠা জমি কেনেন মোবারক। ওই পাঁচ কাঠা জমির তিন কাঠার মধ্যে পাঁচতলা একটি বাড়ি করেন। ১৯৯১ সাল থেকে তাঁর পরিবার সেখানেই বসবাস করে আসছে। পাশের দুই কাঠা জমিতে টিনশেড দুটি কক্ষ তুলে ভাড়া দিয়েছিলেন। সেই দুই কাঠার ওপর নির্মিত টিনশেডের বাড়িটিই দখল করে নেন স্থানীয় যুবলীগের নেতারা।

মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের অভিযোগ, গত ১৬ মার্চ বিকেলে কাফরুল থানা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলমগীর হোসেনসহ ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল এসে বাড়িটির প্রধান ফটক ভেঙে দখল করে নেয়। ওই সময় দখলকারীরা ভাড়াটিয়া মো. রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রীকে মারধর করে কক্ষ থেকে বের করে দেয়। ভাড়াটিয়াদের ঘরে থাকা মালামাল রাস্তায় ছুড়ে ফেলে তারা। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী সালেহা পারভিন সরকার এবং মেয়ে সারাহ মোবারক সরকারসহ পরিবারের সদস্যরা বাধা দিতে গেলে তাদের ওপর চড়াও হয় যুবলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর বাড়ি দখলের বিরুদ্ধে কথা বললে তারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যদের প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়।

পরিবারের সদস্যরা জানায়, হুমকির পর থেকে তারা মূল বাড়ি থেকেও বের হচ্ছে না। এতে মুক্তিযোদ্ধার নাতি হাফিজ আরমান হামির (১১) স্কুলে যাওয়া এক মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। সে ইস্ট ওয়েস্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র।

ওই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার জানায়, এর আগে ২০১২ সালের ডিসেম্বরেও একবার ওই জমি দখলের জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়েছিল যুবলীগ নেতা আলমগীর হোসেন ও তাঁর বাহিনী। কিন্তু ওই সময় জমি দখলে নিতে পারেনি তারা। তবে ওই হামলার পর মুক্তিযোদ্ধা মোবারকের বড় মেয়ে তামান্না ফেরদৌস মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। সেই তামান্নারই ছেলে হাফিজ আরমান হামি।

গত ২২ মার্চ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধার টিনশেডের বাড়িটির দুটি কক্ষেই তালা ঝুলছে। দখল নেওয়া জমির পশ্চিম পাশে সীমানা দেয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই টিনশেডের ভাড়াটিয়া রফিকুল ইসলামের পরিবার এখন মুক্তিযোদ্ধার পাঁচতলা বাড়ির ছাদের ওপর আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে এলোমেলোভাবে জিনিসপত্র পড়ে আছে।

সেই দিনের ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাইলে ভয়ে রফিকুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী কেউ মুখ খুলতে চাননি।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের সদস্যরা জানায়, দুপুরে তারা ভাত খাওয়ার সময় ঘরের পেছনের দেয়াল ভেঙে বাড়িটি দখল করে নেন যুবলীগ নেতারা। থানার পুলিশকে জানানো হলে তাদের জমির কাগজপত্র নিয়ে থানায় যেতে বলা হয়। দখলকারীদেরও থানায় ডাকা হয়েছে বলে তারা শুনতে পেয়েছেন।

মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী সালেহা সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে আমার স্বামী অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন। দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরব আছেন। প্রবাসে তাঁর কষ্টার্জিত টাকায় জমি কিনে বাড়ি করলাম। সেই বাড়ি কিনা যুবলীগ নেতা আলমগীর হোসেন ও তাঁর লোকজন দখল করে নিল। প্রতিবাদ করলে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে এবং প্রাণনাশের হুমকিও দেয় তারা। ’

সালেহা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের বাড়িও দখলে নিয়ে যায় যুবলীগ নেতারা। এর চেয়ে কষ্টের কী হতে পারে! পরিবারের সবাই একপ্রকার অবরুদ্ধ হয়ে আছি। বাড়ির বাইরে গেলে কোন সময় হামলা করে, সেই ভয়ে বাড়িতে থাকছি। বাজারসহ জরুরি কাজ করছে কাজের লোকেরা। ’

সৌদি আরব থেকে মোবাইল ফোনে মুক্তিযোদ্ধা মোবারক হোসেন সরকার বলেন, ‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আমাকে মোহাম্মদপুরে একটি বাড়ি দিতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আমি নিইনি। তখন নেতাকে বলেছিলাম, যার খুব বেশি দরকার লিডার তাকে দিন। পরে আমার উপার্জিত টাকায় শেওড়াপাড়ায় বাড়িটি কিনেছিলাম। সেখানকার কিছু অংশ জমি যুবলীগ নেতারা দখলে নিয়ে যায়। এটা শুনে প্রবাসে থেকে চোখের পানি ফেলা ছাড়া আমার কী করার আছে। ’

শ্রীপুর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম জানান, মোবারক ও তাঁরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মোবারক তো প্রায় মারাই পড়েছিলেন। সেই মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলে নিয়েছেন যুবলীগের নেতারা। এটা খুবই কষ্টদায়ক। সরকারকে ওই দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং মুক্তিযোদ্ধার বাড়িটি উদ্ধার করে দেওয়ার দাবি জানান ওই দুই মুক্তিযোদ্ধা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানায়, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম জাহিদের ঘনিষ্ঠ আলমগীর হোসেন। এস এম জাহিদের নাম ভাঙিয়ে সেই আলমগীর হোসেন ও তাঁর ক্যাডার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধার বাড়িটি দখলে নিয়ে যায়। ক্যাডারদের ভয়ে সাধারণ মানুষ কিছু বলবে দূরের কথা, পুলিশও কথা বলতে ভয় পায়।

অভিযোগ অস্বীকার করে আলমগীর হোসেন বলেন, ‘উনারা প্রকৃত মালিক নন, যারা প্রকৃত মালিক তারা জমিটি দখলে নিয়ে যায়। প্রতিবেশী হিসেবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। ’ প্রাণনাশের হুমকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা মিথ্যা অভিযোগ। ’

মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলে নেওয়া প্রসঙ্গে রাজধানীর কাফরুল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সিকদার মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘পূর্ব শেওড়াপাড়ায় একটি বাড়ির জমির মালিকানা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। দুই পক্ষই বাড়ির মালিকানা দাবি করেছে। সেই বাড়ির বিষয়ে আমরা বলেছি, যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। জমির মালিকানা নির্ধারণ করতে আদালতের শরণাপন্ন হতে বলেছি। ’ দেয়াল নির্মাণ করে বাড়িটি দখলে নেওয়া এবং বাড়ির কক্ষ তালাবদ্ধ করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এমন ঘটনা আমার জানা নেই। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *