দীর্ঘ সাত দশকেও কাস্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়নি

 

 

আনোয়ারুল হক আনোয়ার : পৃথিবীর ভূ-সর্গ কাস্মীর উপত্যাকার অপর নাম এশিয়ার আগ্নেয়গিরি । ৩৭০ মিটার উচ্চতা এবং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে প্রবাহিত হ্রদ বেষ্টিত প্রকৃতির অপরুপ লীলাভূমি কাস্মীর হচ্ছে পর্যটকদের আকর্ষনীয় স্থান । আবার কাস্মীর উপত্যাকায় ত্রি-শক্তির দখলদারিত্বকে কেন্দ্র করে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে । কাস্মীরের আয়তন ২ লাখ ২২ হাজার ২৩৬ বগ কিলোমিটার । এরমধ্যে ভারত শাসিত জম্মু কাস্মির আঞ্চলের আয়তন ১ লাখ ৫৬৯ বর্গকিলেমিটার, পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাস্মিরের আয়তন ৭৮ হাজার ৯৩২ বর্গকিলোমিটার এবং চীন শাসিত আকসাই কাস্মীরের আয়তন ৪২ হাজার ৭৩৫ বর্গকিলোমিটার । অর্থাত ভারত কাস্মীরের ৪৩%, পাকিস্তান ৩৭% আজাদ কাস্মীর, উত্তরাঞ্চলীয় গিলগিট ও বেল্টিস্থান এবং চীন ২০% আকসাই চীন নিয়ন্ত্রন করছে । জম্মু কাস্মীর উপত্যাকায় জনসংখ্যা ১ কোটি ৩২ লাখ । এরমধ্যে মুসলমান জনসংখ্যা হচ্ছে, ৮১% । জম্মু কাস্মীর নিয়ন্ত্রনে ভারতের ৬ লাখ সেনা মোতায়েন রয়েছে । কাস্মীর নিয়ে পাক – ভারত ১৯৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ সালে ৪ টি যুদ্ব সংঘটিত হয়েছে ।

 

১৯২৫ সালে হরি সিং কাস্মীরের রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৪৭ সাল পয্যন্ত তিনি একনাগাড়ে  দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের অন্যতম শত ছিল ভারতের দেশীয় রাজ্যের রাজাগন ভারত কিংবা পাকিস্তানে যোগ দিতে পারবে অথবা স্বাধীনতা বজায় রেখে শাসনকায পরিচালনা করতে পারবে । ১৯৪৭ সালের ২০ অক্টোবর পাকিস্তান সমথিত আদিবাসীরা কাস্মীরে প্রবেশ করে । ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর রাজা হরি সিং কাস্মীরকে ভারতভুক্তির চুক্তিতে সই করেন । চুক্তির পর্ ভারতীয় সেনারা কাস্মীর প্রবেশ করে অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্বে যুদ্বে লিপ্ত হয় । ভারত বিষয়টি জাতিসংঘে উল্থাপন করে । জাতিসংঘ ভারত ও পাকিস্তানকে তাদের অধিকৃত এলাকা খালি করে জাতিসংঘের তত্বাবধানে গনভোট অনুষ্ঠানের প্রস্তাব দেয় । ভারত প্রথমে এ প্রস্তাবে সম্মত থাকলেও ১৯৫২ সালে জম্মু ও কাস্মীরের গনপরিষদ ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিলে ভারত জাতিসংঘ কতৃক গনভোটে অনাস্থা দেয় । এক পযায়ে ভারত ও পাকিস্তানে জাতিসংঘের সামরিক পযবেক্ষক টীম উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ববিরতি তত্বাবধানে যোগ দেয় । যুদ্ব বিরতির শত হিসেবে কাস্মীর থেকে উভয় দেশের সেনা প্রত্যাহার ও গনভোট অনুষ্ঠান । কিন্তু ভারত গনভোটে সম্মত না হলে পাকিস্তানও সেনা প্রত্যাহারে অনীহা প্রকাশ করে ।

 

কাস্মীর অথ হচ্ছে ”শুল্কভূমি” । ১৮১৯ খৃীস্টাব্দে শিখ মহারাজা রনজিত সিংহ কতৃক কাস্মীর বিজয়ের পূবে পাশতুন উপজাতীয় দুরানি রাজবংশ এখানে শাসন করেন । প্রথম ইঙ্গ – শিখ যুদ্ব পরবতী লাহোর চুক্তিবলে কাস্মীর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে আসে । এর কিছুদিন পর অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে গোটা কাস্মীর রাজা গুলাব সিং এর নিকট বিক্রি করে দেযা হয় । যার সুবাদে গুলাব সিং জম্মু ও কাস্মীরের মহারাজা উপাধি লাভ করেন । তখন থেকে ১৯৪৭ সাল অর্থাত দেশ বিভাগ পর্য্যন্ত কাস্মীর হিন্দু রাজ মহারাজাদের শাসনাধীনে ছিল । তখন জম্মু ও লাখাদ অঞ্চল ব্যতীত সমগ্র রাজ্যটিতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল বেশী । ১৯৪৮ সালের দিকে পাকিস্তান কাস্মীরের কিছু অংশ চীনকে  ছেড়ে দেয় । জাতিসংঘ কর্তৃক গনভোট প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ভারতের যুক্তি ছিল ১৯৫২ সালে কাস্মীরের গনপরিষদ ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট প্রদান করে এছাড়া ১৯৪৮ সালের ১৩ আগষ্ট জাতিসংঘের প্রস্তাব অনূযায়ী পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সেনা প্রত্যাহার করেনি । ষষ্ঠ শতাব্দিতে ভারত ভ্রমনে আসা চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর লিখা বইতে কাশ-কি-লো অথাত কাস্মীর রাজ্যের কথা বলা হয়েছে এবং যার অস্তিত্ব ছিল প্রথম শতাব্দি থেকে ।

 

ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাস্মীরে মানবাধিকার পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয় বলে মিডিয়ার সুবাদে জানা যায় । ভারতের শাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হবার লক্ষে সেখানে জঙ্গী হামলা অব্যাহত রয়েছে । ১৯৯৯ সালে কাগিল যুদ্ব, ২০০৬ সালে শ্রীনগরে বোমা বিস্ফোরন, ২০১৩ সালে শ্রীনগরে জঙ্গী হামলা, ২০১৩ সালে বেমিনা সিআরপি ক্যাম্পে ভয়াবহ জঙ্গী হামলাসহ সেনা টহলে চোরাগোপ্তা হামলা নিত্তনৈমক্তিক ঘটনা । জম্মু ও কাস্মীর উপত্যাকায় আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি ঘটায় পযটন খাতে ভারত প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে । অপরদিকে পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাস্মীর প্রেরিয়ে পাক – চীন কারাকোরাম সড়ক ভারতের জন্য হুমকি মনে করছে নয়াদিল্লী । এছাড়া চীনের অধিকৃত আকসাই অঞ্চলে বিপূল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে বেজিং । এক কথায় প্রায় সোয়া দুই লাখ বগকিলোমিটার আয়তনের কাস্মীর উপত্যাকায় পাক – ভারত ও চীনের প্রায় ১০/১১ লক্ষাধিক সেনা মোতায়েন রয়েছে যেটা একটা রেকড বিশেষ । ভারত জম্মু ও কাস্মীরের নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লী । বিরোধীয় অঞ্চল সমূহে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েনের পাশাপাশি রেড এলাট জারী করে রেখেছে । ইসলামাবাদ ও বেজিং চাইছে জম্মু কাস্মীর ইস্যুতে ভারতকে সব সময় চাপের মধ্যে রাখা । ভারতের ভয় হচ্ছে কোন ক্রমে জম্মু কাস্মীর হাতছাড়া হলে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যও বিচ্ছিন্নতার দাবী জোরালো হবে । সুতরাং এশিয়ার আগ্নেয়গিরি হিসেবে খ্যাত কাস্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভারতের সাথে পাকিস্তান ও চীনের সাথে ভারতের উত্তেজনা বিরাজ করছে । ফলে অদূর ভবিষ্যতে সোয়া দুই লাখ বগকিলোমিটার আয়তনের কাস্মীর উপত্যাকায় সূ-বাতাস প্রবাহিত হবার আশা সূদূর পরাহুত ।

 

লেখক : সিনিয়র রিপোটার এবং আন্তজাতিক বিশ্লেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *