বাঁধ প্রকল্পে অনিয়ম: শর্ত পূরণ হয়নি তবুও ছাড় ৮৩ কোটি টাকা

সুনামগঞ্জ-
হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শর্ত অনুযায়ী সম্পন্ন না করার পরও প্রায় ৮৩ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। এমনকি নির্ধারিত সময়ের পর আরও দুই দফা সময় বাড়িয়েও সেই কাজ শেষ করতে পারেনি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)।

এরই মধ্যে বন্যায় প্লাবিত হয়েছে গোটা হাওরাঞ্চল। ফলে কতটুকু কাজ হয়েছে- তা যাচাই-বাছাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সমাপনী বিল পরিশোধের নামে আরও ২০ কোটি টাকা চেয়েছেন পিআইসি প্রধান (জেলা প্রশাসক)। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

আরও জানা গেছে, বিল ছাড় করার আগে জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) মোহাম্মদ এমরান হোসেন সতর্ক করেছিলেন কিন্তু সেটি উপেক্ষা করেই ‘রহস্যজনক’ কারণে সেই বিল ছাড় করা হয়। ওই চিঠি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকসহ জেলার ১১ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠানো হয়।

জানতে চাইলে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। বিল প্রদানে সতর্ক করে উপ-পরিচালকের চিঠির বিষয়টি আমার নজরে এখনও পড়েনি। বিষয়টি আমি দেখব।

জানতে চাইলে হাওর বাঁচাও কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু রোববার টেলিফোনে বলেন, শুরু থেকেই হাওর রক্ষা বাঁধের নামে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এতে একদিকে সরকারি টাকার অপচয় অন্যদিকে লুটপাটের সংস্থান রাখা হয়েছে বলে আমি মনে করি। এ কারণেই আমরা বাস্তবে কতটুকু কাজ সম্পন্ন হয়েছে- তা যাচাইয়ের জন্য চূড়ান্ত বিল পরিশোধের আগে ‘পোস্ট ওয়ার্ক মেজারমেন্ট’ করতে স্মারকলিপি দিয়েছি।’ তিনি বলেন, বাঁধ সংস্কারের সময়ই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং করে অসঙ্গতি তুলে ধরেছিলাম।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক উপ-পরিচালক বিল পরিশোধে সতর্ক করে ইউএনওদেরকে চিঠি দিয়ে থাকলে প্রমাণ হয় হাওর বাঁচাও আন্দোলন যে অভিযোগ করেছে সেটা সঠিক। কারণ আমরাও বলছি শর্ত অনুযায়ী কাজ করেনি পিআইসি। এরপর জেলা প্রশাসক এই বিলের নামে প্রায় ৮৩ কোটি টাকা ছাড় করেছেন। এখন আবারও আরও ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়ায় প্রমাণ করে আমাদের যৌক্তিক দাবি জেলা প্রশাসক (ডিসি) আমলে নিচ্ছেন না। তিনি বলেন, এখন সমস্ত এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। তাই বাঁধে কী পরিমাণ কাজ হয়েছে তা যাচাই-বাছাইয়েরও সুযোগ নেই। তাহলে বিলটা পরিশোধ হবে কি হাওয়ার ওপরে?

একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, বাঁধে কী কাজ হয়েছে তা আমরা ভিডিও করে রেখেছি। সব প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। বাঁধে কাজের নামে সরকারি টাকা লুটপাটের সুযোগ যারা করে দেবেন তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনের আশ্রয় নেব। বিষয়টি এভাবে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে যে ৮৩ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে তার অর্ধেক টাকার কাজ হতে পারে।’

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বৈশাখ মাসে যখন হাওরাঞ্চলের বোরো ফসল কাটা শুরু হয়, ঠিক তখনই চিঠি দেন উপ-পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন। ১১ এপ্রিল স্বাক্ষরিত চিঠিতে মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘পিআইসি সদস্যরা শর্ত অনুযায়ী কাজ না করায় বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য অনুরোধ করা হল।

সিডিউল অনুযায়ী বিভিন্ন আইটেমে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের বিষয়ে চিঠিতে বলা হয়, অনেক পিআইসির ক্ষেত্রে কিছু কিছু আইটেম প্রাক্কলন অনুযায়ী যথাযথভাবে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হয়নি। যেমন মাটি কাটার ক্ষেত্রে সাধারণ শ্রমিক রাখার সংস্থান রাখা হয়েছে। বাস্তবে এক্সকেভেটর দিয়ে কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাঁধের ৩০ মিটার এলাকা থেকে মাটি না কাটতে বলা হলেও তা মানা হয়নি।’ এছাড়া সিডিউলে যেসব আইটেম মাঠ পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন করা হয়নি সে সব বিল প্রদানে সতর্ক করা হয় চিঠিতে।

জানা যায়, গেল বোরো মৌসুমে সুনামগঞ্জের ছোটবড় মিলিয়ে ৫২টি হাওরে ৬শ’ ৩৬ কি.মি হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও পুনঃমেরামত করা হয়। ৭৪৯টি পিআইসি গঠন করা হয়। প্রাথমিক বরাদ্দ হয় ৬৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এরপর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও পাউবোর উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে প্রতিটি উপজেলায় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এই বরাদ্দ ১৩২ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকায় দাঁড়ায়। এ অবস্থায় আন্দোলনে নামে হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটি। গত ১১ জুন কমিটির নেতারা সে সময় থেকেই অপ্রয়োজনীয় বাঁধ বাতিলের দাবিতে জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপিও দেয়।

এমন পরিস্থিতির মধ্যেই সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ ১৪ জুন জরুরি ভিত্তিতে ২০ কোটি টাকা সমাপ্ত বিল পরিশোধে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। এই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘২০১৯-২০ অর্থবছরে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে পাউবোর ডুবন্ত বাঁধের ভাঙন বন্ধকরণ ও মেরামত কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জেলা কমিটি কর্তৃক চূড়ান্ত অনুমোদিত ৭৪৫টি স্কিমের প্রাক্কলিত মূল্য ১শ’ ৩২ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকার বিপরীতে বিভিন্ন উপজেলা থেকে মোট ১শ’ ১৩ কোটি ৩৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকার চাহিদা সংবলিত সমাপনী প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

এসব প্রতিবেদন যাচাইপূর্বক চূড়ান্ত ব্যয় নিরূপণকল্পে পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর-পূর্বাঞ্চল), সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক কর্তৃক ভিন্ন দুটি যাচাই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদন অনুযায়ী ৭৪৫টি পিআইসির সংশোধিত প্রাক্কলিত মূল্য ১শ’ ৩২ কোটি ১ লাখ ৬৩ হাজার টাকার মধ্যে ১শ’ ২ কোটি ৯৪ লাখ ৯১ হাজার টাকা ১১টি উপজেলার বিপরীতে প্রদান করা যায় মর্মে সুপারিশ করা হয়। যা প্রাক্কলিত মূল্যের ৭৭ দশমিক ৯৮ ভাগ। ১৪ জুন অনুষ্ঠিত কাবিটা স্কিম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জেলা কমিটির সভায় গঠিত কমিটির সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হয়।’

চিঠিতে পরিশোধিত বিলের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, এর আগে সংশ্লিষ্ট পিআইসিকে ৮২ কোটি ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ছাড়করণ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় পিআইসিকে চূড়ান্ত বিল প্রদানে ২০ কোটি ৬ লাখ ৫ হাজার টাকা জরুরি ভিত্তিতে অবমুক্তকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ।

বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণে বিল প্রদানের ক্ষেত্রে একজন পদস্থ কর্মকর্তার সতর্কতামূলক চিঠি দেয়ার পর বন্যার এই সময়ে আরও ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ সাংঘর্ষিক কিনা- জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ যুগান্তরকে বলেন, সংশ্লিষ্ট কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে বিল চাওয়া হয়েছে। পোস্ট ওয়ার্ক মেজারমেন্ট না করে কীভাবে চূড়ান্ত বিল করলেন জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক বলেন, পোস্ট ওয়ার্ক মেজারমেন্ট আমি দেখি না। এটা করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জেলা প্রশাসন এর সঙ্গে যুক্ত নয়। যেভাবে সুপারিশ এসেছে সেভাবেই বিল চাওয়া হয়েছে।

সতর্ক করার পরও জেলা প্রশাসক প্রায় ৮৩ কোটি টাকা ছাড় করার পরও সমাপ্ত বিল পরিশোধে আরও ২০ কোটি টাকা চেয়েছেন বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন- প্রশ্ন করা হলে বিদায়ী উপ-পরিচালক (উপ-সচিব) বর্তমানে সিলেট পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মোহাম্মদ এমরান হোসেন বলেন, ‘ভাই এখন আর এ বিষয়ে কথা বলে কী হবে? আমি গত ১৮ জুন সুনামগঞ্জ থেকে চলে এসেছি। এ বিষয় নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাচ্ছি না।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *