মুহাম্মদ কাইসার হামিদ, কিশোরগঞ্জ :
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ৫ম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে কুলিয়ারচর থানায় দায়ের করা বহুল আলোচিত মামলা থেকে ৩ জন আসামীর নাম প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে পৃথক পৃথক ভাবে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবর আবেদন করেছে মামলার বাদী ভিকটিমের বাবা মো. আপেল মিয়া।
গত ১৯ জুন তারিখে স্বাক্ষরিত এক লিখিত আবেদনে মো. আপেল মিয়া উল্লেখ করেন, গত ১৭ জুন কুলিয়ারচর থানায় দায়ের করা মামলা নং ০৯/১২১ এর ২নং আসামী উপজেলার সালুয়া ইউনিয়ন পরিষদের ২নং ওয়ার্ড মেম্বার দড়িগাঁও গ্রামের মো. নিজাম উদ্দিন (৫০), দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মো. কামরুল হাসান (৪৫) ও বিদ্যালয়ের দপ্তরী মো. এমাদ মিয়া (৩৫) তাকে উক্ত ঘটনা মিমাংসা করার জন্য কোন প্রকার ভয়ভীতি প্রদান করে নাই এবং তাদের বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ নাই।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী মো. আপেল মিয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার দায়ের করা মামলা থেকে ২, ৩ ও ৪ নং আসামীর নাম প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে পৃথক পৃথক আবেদন করার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমি অশিক্ষিত মানুষ। কুলিয়ারচর ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সদস্যরা মামলাটি লিখেছে। মামলার এজাহারে তারা কি লিখেছে আমি জানিনা। আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলছে আমি স্বাক্ষর দিয়েছি। পরে জানতে পারলাম মামলায় প্রকৃত আসামী ছাড়াও আরো ৩ জনকে আসামী করা হয়েছে। তারা এ ঘটনার সাথে জড়িত নয়।
মামলার আসামী মো. নিজাম উদ্দিন, মো. কামরুল হাসান ও মো. এমাদ মিয়া ঘটনার সাথে জড়িত নয় দাবী করে বলেন, সমাজে তাদের মান সন্মান ক্ষুন্ন করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে একটি কুচক্রী মহল তাদের নামে এ মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে মামলায় তাদের নাম লিখিয়েছে। তারা এঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।
উল্লেখ্য, কোভিট-১৯ করোনা ভাইরাস সংক্রমণ আতংকে মানুষ যখন দিশেহারা। তখনই সরকারি নির্দেশে সারা দেশে স্কুল-কলেজে পাঠদানসহ প্রাইভেট কোচিং-এ পড়ানো সম্পূর্ণ নিষেধ ঘোষণা করা হলেও সরকারি নির্দেশ অমান্য করে উপজেলার দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সেলিম মিয়া (৪২) উপজেলার পূর্ব আব্দুল্লাপুরস্থ তার নিজ বাড়িতে একটি প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে প্রাইভেট পড়ানোর সময় তারই স্কুলের এক ৫ম শ্রেণির ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করে।
এ ঘটনায় গত ১৬ জুন ১২.৫০ পিএম সময় অনলাইন নিউজ ভার্সন পূর্বকণ্ঠ ডটকম-এ “ কুলিয়ারচরে ফের সেলিম মাস্টারের বিরুদ্ধে এক স্কুল ছাত্রীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ! বিচার দাবীতে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদটি দেখে কুলিয়ারচর থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুল হাই তালুকদার ওই দিন থানার এসআই মো. আতাউর রহমানকে ওই স্কুল ছাত্রীর বাড়িতে পাঠান । এসআই মো. আতাউর রহমান সেলিম মাস্টারের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বস্ত করে স্কুল ছাত্রীর বাবাকে থানায় এসে লিখিত অভিযোগ করতে বলেন।
পরে স্কুল ছাত্রীর বাবা কুলিয়ারচর ছাত্রকল্যাণ পরিষদের সদস্যদের সহযোগিতায় ওই দিন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ইয়াছির মিয়া ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার রুবাইয়াৎ ফেরদৌসীর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পরদিন ১৭ জুন বুধবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে স্কুল ছাত্রীর বাবা মো. আপেল মিয়াকে বাদী করে সেলিম মাস্টারকে প্রধান আসামি করে ৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত নামা ৫/৬ জনকে আসামি করে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধনী-২০০৩ এর ১০ তৎসহ ৫০৬ দ.বি. ধারায় কুলিয়ারচর থানায় একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। মামলা নং-০৯। মামলায় অন্যান্য আসামিরা হলেন মো. নিজাম উদ্দিন মেম্বার (৫০), মো. কামরুল হাসান (৪৫) ও এমাদ মিয়া (৩৫)।
ছাত্রীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, গত ৯ জুন মঙ্গলবার সকালে দড়িগাঁও গ্রামের মো. আপেল মিয়ার কন্যা দড়িগাঁও সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৫ম শ্রেণির ছাত্রী (১১) প্রতিদিনের ন্যায় ওই সেলিম মাস্টারের বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে যায়।
প্রাইভেট রুমে সুযোগ বুঝে লম্পট শিক্ষক ওই ছাত্রীকে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করে। ওই দিন প্রাইভেট পড়ার শেষে ওই স্কুল ছাত্রী বাড়িতে এসে কান্না-কাটি করে তার মায়ের নিকট এ ঘটনা খুলে বলে। এর পর বিষয়টি দড়িগাঁও এলাকায় জানা-জানি হলে এলাকাবাসীর মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করে। ঘটনার পর থেকে এলাকায় তোলপার শুরু হয় । এ নিয়ে এলাকার যুব সমাজ সেলিম মাস্টারের বিচার দাবীতে গত ১৫ জুন রাত ৭টার দিকে স্থানীয় মুজরাই মোড় বাজার রাস্তায় বিক্ষোভ মিছিল বের করে।
এরপর গত ১৭ জুন সকাল ১০টার দিকে সেলিম মাস্টারের বিচারের দাবীতে দড়িগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে এলাকাবাসী একটি মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। এছাড়া গত ২৬ জুন সকালে উপজেলার সালুয়া ফাজিল মাদ্রাসার সামনে বেলাব – ডুমরাকান্দা রাস্তায় স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ফ্রেন্ডস ক্লাবের উদ্যোগে ঘন্টাব্যাপী এক মানববন্ধনে বক্তারা পুলিশকে দোষারোপ করে বলেছিলেন, রহস্যজনক কারনে বহুল আলোচিত আসামী সেলিম মাষ্টারকে গ্রেফতার করছেনা পুলিশ।
এ বক্তব্যসহ মানববন্ধনের সংবাদ দৈনিক পূর্বকণ্ঠ পত্রিকা সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে পুলিশ প্রশাসনের টনক নড়ে। অবশেষে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে কুলিয়ারচর থানার এস আই আবুল কালাম আজাদ ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম শুক্রবার (৩ জুলাই) দুপুর ২টার দিকে নরসিংদী জেলার আমিরগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি ভাড়াটিয়া বাসা থেকে সেলিম মাষ্টারকে গ্রেফতার করে।
সেলিম মাষ্টারকে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুল হাই তালুকদার বলেন, মামলার মূল আসামী গ্রেফতার হওয়ায় মামলাটির অগ্রগতি হয়েছে।
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. কবির উল্লাহ ও ডুমরাকান্দা ক্লাস্টারের সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. জামাল উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, বিষয়টি লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।