নিউজ ডেস্ক :
একটি নয়, দুটি ‘রাজাকার ভবন’-এ ক্যাসিনো সাঈদের রাজত্ব। একদল ক্যাডার নিয়ে ভবন দুটি নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনি। তার ক্যাডার বাহিনীতে আছে ছাত্রলীগ মহানগর দক্ষিণের সভাপতি মেহেদী হাসান, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান, ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান উদ্দিন জামাল, ৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমান আকাশ, থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক শফিকুল ইসলাম সেন্টু।
মতিঝিল, আরামবাগ, দিলকুশা এলাকার কেউ তাদের অবাধ্য হলেই রাজাকার ভবনের টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন চলত। মতিঝিলের ৮৯ এবং ৮৯/১ আরামবাগে ওই দুটি রাজাকার ভবনের অবস্থান। একটি ভবন ৮ তলা এবং অন্য একটি ভবন ৪ তলাবিশিষ্ট। ভবন দুটি এক সময় হাজীর ভবন হিসেবে পরিচিত ছিল।
মীর কাসেম আলী কেনার পর নাম দেয়া হয় বাংলাদেশ পাবলিকেশন্স লিমিটেড (বিপিএল) ভবন। পরে এটি স্থানীয়দের কাছে রাজাকার ভবন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ২০১২ সালে যুদ্ধাপরাধের মামলায় জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী গ্রেফতার হওয়ার পরই ওই দুটি ভবনের দিকে নজর পড়ে যুবলীগ যুগ্ম সম্পাদক মমিনুল হক সাঈদের।
২০১৫ সালের এপ্রিলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর হওয়ার পর লাগোয়া দুই ভবনের একটিতে অফিস খোলেন সাঈদ। ২০১৬ সালে মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ভবন দুটি থেকে মীর কাসেমের স্টাফদের বের করে দিয়ে রাতারাতি দখল করে নেন সাঈদ। এরপর ৮৯ নম্বর আরামবাগের রাজাকার ভবনের দ্বিতীয়তলায় গড়ে তোলেন টর্চার সেল। ভবন দুটির ভাড়াটিয়াদের ডেকে বলেন, এখন থেকে সব ভাড়া আমাকে দেবেন।
এরপর থেকে ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ভাড়া তুলছেন সাঈদের ক্যাডাররা। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি এবং ক্যাসিনো বাণিজ্যে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালেই তাকে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তুলে রাজাকার ভবনে নিয়ে নির্যাতন করতেন সাঈদ। এ ক্ষেত্রে নিজ দলের হলেও রেহাই পেতেন না। সাঈদের ক্যাডার বাহিনীর কেবল দুই রাজাকার ভবন থেকেই চাঁদা এবং ভাড়া নয়, আরামবাগ ফকিরাপুল এলাকার সব দোকান থেকে দিনে ১০০ টাকা করে চাঁদা তোলেন। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে সাঈদের বিরুদ্ধে।
ক’দিন আগেও রাজাকার ভবনে তরুণীদের আনাগোনা দেখা গেছে। পাশের ইয়ংমেনস ক্লাবসহ যেসব ক্লাবে ক্যাসিনো চলত সেখানে সুন্দরী তরুণীদের উপস্থিতি ছিল। ওইসব তরুণী রাজাকার ভবনে থাকতেন বলেন স্থানীয়রা জানায়। সাঈদের ক্যাডাররা রাজাকার ভবনে চালু করেছিল ইয়াবা বারও।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের মুখে ক্যাসিনো, ইয়াবা বার বন্ধ হয়েছে। সাঈদ পালিয়ে সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন। কিন্তু এখনও দুই রাজাকার ভবন রয়েছে সাঈদের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের দখলেই। বুধবার সকালে ভবন দুটিতে গিয়ে তাদের তৎপরতা চোখে পড়েছে।
বুধবার ৮৯ নম্বর রাজাকার ভবনে গিয়ে জানা যায়, নিচতলা থেকে ৪ তলা পর্যন্ত ৪৪টি কক্ষ বিভিন্ন পাবলিকেশন এবং অফিসের জন্য ভাড়া দেয়া হয়েছে। ৪ তলা থেকে ৮ম তলা পর্যন্ত ফ্যামেলি ভাড়া দেয়া। প্রতিটি কক্ষের ভাড়া কমবেশি ১০ হাজার টাকা। এ ভবনের এক ভাড়াটিয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, এখানে একটি অফিস ভাড়া নিয়ে ৭-৮ বছর ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছি।
আগে মীর কাসেমের ম্যানেজার জয়নাল ভাড়া নিতেন। এখন ভাড়া আদায় করছেন সাঈদ কাউন্সিলরের ম্যানেজার রাব্বি। তিনি বলেন, দ্বিতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর একদিন সাঈদ কাউন্সিলর দলবল নিয়ে এসে ভবনের স্টাফদের বলেন, এখানে তোমরা কেউ থাকতে পারবে না।
সবাই চলে যাও। এরপর যদি তোমাদের কাউকে দেখি তাহলে কেউ প্রাণে বাঁচবা না। এরপর মীর কাসেমের স্টাফরা চলে যান। পরে কাউন্সিলর ও তার লোকজন ভাড়াটিয়াদের ডেকে বলেন, ‘আপনাদের কোনো সমস্যা নেই। আপনারা যে যার মতো করে অবস্থান করুন। ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যান। এখন থেকে আমাদের কাছে ভাড়া দেবেন। এরপর থেকে কাউন্সিলর সাঈদের ম্যানেজার রাব্বির কাছে ভাড়া পরিশোধ করি।’
রাজাকার ভবনের অপর এক বাসিন্দা বলেন, ‘সাঈদ কাউন্সিলরের অফিসে দোতলার অফিসে প্রায়ই মিটিং হতো। মিটিংয়ের সময় অনেক অস্ত্রধারী আসত। তারা স্থানীয়দের সঙ্গে খুবই খারাপ আচরণ করত।’
আয়নাল হক নামের এক ভাড়াটিয়া বলেন, ‘তাদের অত্যাচারের মাত্রা এত বেড়ে গিয়েছিল যে, আমরা অনুমান করতে পারছিলাম একটা কিছু হওয়ার সময় এসেছে। সম্প্রতি ছাত্রলীগের ৪ কর্মীকে এখানে এনে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। কারণ তারা সাঈদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ও মতিঝিল থানা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসান উদ্দিন জামালের অনুসারী ছিল না। যাদের নির্যাতন করা হয়েছে তারা হলেন, রবিউল ইসলাম, রাকিব আহমেদ ভুঁইয়া, মোহাম্মদ অলি চৌধুরী ও রাজন হোসেন। কেবল নির্যাতন করেই সাঈদ বাহিনীর লোকজন ক্ষান্ত হয়নি। মিথ্যা মামলায় তাদের জেলহাজতেও পাঠানো হয়। আয়নাল হোসেন বলেন, সাঈদের টর্চার সেলে ফাইবারের লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। বেঁধে রাতভর দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। শরীরের গিরায় গিরায় এবং হাত-পায়ের তালুতে পেটানো হতো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানের পর দ্বিতীয়তলার অফিস থেকে নির্যাতন সামগ্রী সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে এখনও তার ক্যাডাররা সেখানে অবস্থান করছে।
জানা যায়, মমিনুল হক সাঈদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। পারিবারিক ঝামেলার কারণে ২০০২ সালে তিনি ঢাকায় আসেন। এরপর মতিঝিলের দিলকুশা সাধারণ বীমা কর্পোরেশনের সামনের সড়কে দোকানদারি শুরু করেন। চোরাই তেলের ব্যবসাও করতেন।
থাকতেন বঙ্গভবনের চার নম্বর গেটের কোয়ার্টারে। সেখানে তার মামা চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর চাকরি করতেন। পরে মোহামেডান ক্লাবে হাউজি খেলার সময় আলমগীর ও তাপসের ফুটফরমায়েশ খাটতেন। ২০০৭ সালের পর যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তার সখ্য হয়। তার হাত ধরেই সাঈদ ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হন। পরে যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক হন। এরপর ওয়ার্ড কমিটির সভাপতির পদ ছেড়ে দেন। ওয়ার্ডে তার পদে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় হাসান উদ্দিন জামালকে।
সাঈদ কাউন্সিলরের সেকেন্ড-ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে থাকেন জামাল। জামালের মাধ্যমেই আরামবাগ ক্লাব, দিলকুশা ক্লাব, ভিক্টোরিয়া ক্লাবে ক্যাসিনো-জুয়ার আসর বসাতেন সাঈদ। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএ ভবনে টেন্ডারের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে জামালের পাশাপাশি কামরুল হাসান রিপন ছিল সাঈদের অংশীদার।
কাউন্সিলর হওয়ার নেপথ্যে : স্থানীয়রা জানান, মমিনুল হক সাঈকে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর বানানোর পেছনে রয়েছেন যুবলীগ মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট ওরফে ক্যাসিনো সম্রাট।
সম্রাটকে ম্যানেজ করেই তিনি কাউন্সিলর প্রার্থী হন। অন্য দলের যারা প্রার্থী ছিলেন তাদের বেশির ভাগকেই অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারে বাধ্য করেন। নিজ দলের যারা প্রার্থী ছিলেন তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয় টাকার বিনিময়ে।
যাদের টাকার বিনিময়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করানো হয়েছে তাদের মধ্যে আছেন- সাবেক ছাত্রনেতা পলাশ মজুমদার এবং মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী সাব্বির হোসেন। এই দু’জনের মধ্যে পলাশকে দেয়া হয় ৫ লাখ টাকা। তাছাড়া নির্বাচনে তিনি একাধিক ডামি প্রার্থীও দাঁড় করান। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন আবদুর রহমান। তিনি ঘুড়ি প্রতীকে নির্বাচন করেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য : এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ মতিঝিল থানার সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে কথা বলতে তিনি আকাশ, পলাশ এবং সাব্বিরসহ বেশ কয়েকজনের মোবাইল নম্বর দিয়ে সহযোগিতা করেন।
কথা বলতে ফোন করে সবক’টি নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়ে মতিজিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন মোল্লাহও কোনো মন্তব্য করতে চাননি। জানতে চাইলে মতিঝিল থানার ওসি ওমর ফারুক বলেন, মীর কাসেমের ভবন দখলের বিষয়ে আমরা আগে কিছু জানতাম না। কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করেনি। ক্যাসিনোর বিষয়টি সামনে আসার পর আমরা এ বিষয়ে অভিযান শুরু করেছি। অপরাধী যেই হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।