সহিংসতা নয়, জয়ী হবে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ | বাংলারদর্পন

ড. আতিউর রহমান :

বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চেতনায় সিক্ত একটি দেশ। মূলত গণতন্ত্রের চেতনায় শক্তিশালী হয়ে আমাদের পূর্বপুরুষরা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের সেই চেতনার ভিত্তিতেই হয়েছিল সত্তরের নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বাঙালি বিপুলভাবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে রায় দিয়েছিল। ওই নির্বাচন হয়েছিল অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর আমেজে।

তবে এমন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ফলাফলের ফসল সাংবিধানিক উপায়ে ঘরে তোলা যায়নি। শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে একটি দেশ অর্জন করেছি তা-ই নয়; একটি গণতান্ত্রিক চেতনাও পুনরুদ্ধার হয়েছিল। সেই বাংলাদেশে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের পর আবারও নির্বাচন এসেছে। এই নির্বাচন আমাদের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অংশ।

রাজনীতিতে বিভাজন ও সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার পরও দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে সেই শঙ্কা অনেকটা প্রশমিত করতে পেরেছেন। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে পর পর দুটি সংলাপ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের মাঝে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা ছিল, ওই সংলাপ তা অনেকটা কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এসেছে। আর তা ওই সংলাপেরই ফসল।

এদিকে সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু সহিংসতা ও মারামারি হচ্ছে। এটাকে নির্বাচনের সংস্কৃতির কথা বলা হলেও মানুষ এবারের নির্বাচনকে দেখতে চেয়েছে সত্তরের নির্বাচনের মতো। এবারের নির্বাচন হবে আরো শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত—এমনটাই সবার প্রত্যাশা।

এবারের নির্বাচন যেন শান্ত ও অংশগ্রহণমূলক হয়। নির্বাচনের আচরণবিধি সবাই যেন মেনে চলে। একই সঙ্গে কারো ভোটাধিকার খর্ব করা হলে নির্বাচন কমিশন যেন প্রতিবিধান করতে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এই অসন্তোষ নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। নির্বাচন কমিশনকে সত্যিকারের শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে চায় দেশের জনগণ।

তবে আমার ধারণা, এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিজয়ী হবে। সেই বাংলাদেশে বিশেষ করে দুই কোটি ৩১ লাখ নতুন ভোটার ভোট দেবে। তারা প্রতিদিন গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের সামাজিক মাধ্যমে। এই তরুণরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা বিশ্বের খোঁজখবর রাখে। তারা যেন ভোটকেন্দ্রে যায় তা নিশ্চিত করতে পারা এই সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সুতরাং তরুণ ভোটারদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলতে চাই—আমরা মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি।

তরুণ ভোটাররা যেন ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শঙ্কিত না হয়, তারা যেন গণতন্ত্রের কোনো ব্যত্যয় না দেখে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রবীণদের। ভোটকেন্দ্রে যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো ধরনের উত্তাপ তৈরি না হয় সেটা দেখার দায়িত্ব সব ভোটার ও দলের। বিশেষ করে সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যেন নিরপেক্ষ আচরণ করে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দল-মত-নির্বিশেষে আমাদের সচেতন থাকতে হবে। দলগুলোর নির্বাচনী এজেন্টকে অবশ্যই ভোটের নিয়ম, আচার ও সংস্কৃতিকে বিশ্বাস করতে হবে। নির্বাচনে যে ফলই হোক না কেন তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। কেননা আমরা মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হবে। তাই এটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা কারোই উচিত হবে না।

অর্থনৈতিক দৃষ্টিতেও এবারের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের বিজয়ের সম্ভাবনা বেশি। কেননা বিশ্ব জরিপে দেখা যায়, এক দশক ধরে বর্তমান সরকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে ভিত্তি তৈরি করেছে এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী যে বিচক্ষণতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এর ফলে জনসমর্থন তাদের দিকে থাকবে বেশি। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্টস, রিপাবলিকান ইন্টারন্যাশনাল, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট, এশিয়া ফাউন্ডেশনের জরিপ এসব কথাই বলছে। এতে বলা হয়, একটা উন্নয়নের বিস্ময়কর চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় বাংলাদেশে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্টস বলছে, আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৮.৭ শতাংশ হারে।

সাধারণত দেশে যখন অর্থনৈতিক মন্দা থাকে তখন সাধারণ মানুষ সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর বর্তমান বাংলাদেশে আশাবাদী উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। সেখানে মানুষ তাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো কারণ দেখে না। সুতরাং একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সরকারি দলের নেতাকর্মীদের নিজেদের ওপর আস্থা রাখাটা খুব জরুরি।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *