শেখ আমিনুর হোসেন,সাতক্ষীরা ব্যুরো চীফ: যে হাত দু’টি হতে পারতো ভিক্ষুকের হাত, সেই দু’টি হাতকে কর্মের হাতে পরিণত করেছেন অসহায় দরিদ্র প্রতিবন্ধী ফজর আলী কারিকর (৭০)। নাজিমগঞ্জ বাজারে সবাই তাকে মাষ্টার বা ম্যানেজার বলেই ডাকেন। জন্মের পর থেকেই তার দুই পা নেংড়া ও অকেজো হওয়ায় ভারী কোন কাজকর্ম করতে পারেন না তিনি। পেশায় তিনি একজন খিলি পান ব্যবসায়ী। শারীরিক, মানসিক, অর্থকষ্টসহ নানা সমস্যাও দমাতে পারেনি শারীরিক প্রতিবন্ধী ফজর আলীকে। ২শতক বসতভিটায় ছোট জরাজীর্ণ কুড়ে ঘরে একাই কোন রকমে বসবাস করছে তিনি। বর্তমানে তিনি নাজিমগঞ্জ বাজারে দোকানে দোকানে ফেরি দিয়ে পান বিক্রি করে অভাব অনটনের মধ্যে চলছে তার জীবন ও সংসার। সোমবার দুপুরে নাজিমগঞ্জ বাজারে পান বিক্রয়ের সময় কথা হয় ফজর আলীর সাথে।
তিনি জানান, বাড়ি তার উপজেলার মথুরেশপুর ইউনিয়নের বসন্তপুর গ্রামে। তাহার বাবার নাম মৃত মৈজউদ্দিন মোল্লা। তিনিসহ ৩ভাই ও ১বোন। স্হানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, ফজর আলীর জম্ম গরীব ঘরে এবং জন্মের পর থেকেই তার দুই পা নেংড়া ও অকেজো। বাবা গরীব থাকায় লেখাপড়া কপালে জটেনি। তাছাড়া প্রতিবন্ধী হওয়ায় ভারী কিছু কাজকর্ম করতে পারেন না তিনি। তারপরও অভাবের সংসারে পিতার হাত ধরে কর্মজীবন শুরু হয়। কিন্তু প্রতিবন্ধী ফজর আলী মনের ব্যাথা বুকে নিয়ে উপয়অন্ত না পেয়ে যোগদেন গ্রামে তাঁত শিল্পের কারিগর হিসাবে। তিনি অন্যের বাড়িতে তাঁত চালিয়ে ২ থেকে ৩ জোড়া নিখুদ হাতে তৈরি গামছা বুনে সামান্য মুজুরিতে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারপর কাজ কর্মে থাকার একপর্যায়ে পরিবারের পক্ষ থেকে বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ করান তাকে।
কিন্তু দুঃখের বিষয় তার বিয়ের কিছুদিন পর সুখের সংসারে ভাটা পড়ে। স্ত্রী কোন এক কারণ দেখিয়ে চলে যায় বাপের বাড়ি, আর সংসার করতে ফিরে আসেনি। দুঃখ কষ্টে চিন্তা ভাবনার পরও তাঁতের হাল ছাড়তে নারাজ ছিলেন তিনি। দীর্ঘ প্রায় ২০বছর যাবৎ তাঁতের কারিগর হিসাবে কাজ করার সুবাদে দেখা দেয় চোখের সমস্যা, বাদ দেন তাঁত শিল্পের কাজ। সকল কাজকর্ম বাদ দিয়ে একসময় তিনি ব্যবসা করার উদ্যোগ নেন বাজারে বসে পান বিক্রয় করবো। পরবর্তীতে তিনি বেছে নেন পান বিক্রয়ের পেশা। তাই তিনি প্রতিদিন জীবিকার তাগিদে ঝড়, বৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ উপেক্ষা করে খুব সকালে বের হয়ে পড়েন বাড়ি থেকে ২কি.মি. দূরে নাজিমগঞ্জ বাজারে পান বিক্রির উদ্দেশ্যে। আর পান বিক্রি শেষে কখনও বিকালে, কখনও সন্ধ্যায়, আবার কখনও রাতেও ফেরেন বাড়িতে। পান বিক্রয়ের প্রথম দিকে তিনি অন্যের দোকানের বারান্দায় বসতেন। তাছাড়া বর্তমান সময়ে এক জায়গায় বসে প্রতিবন্ধী ফজর আলীর পান বিক্রয় করা সম্ভব হচ্ছেনা। বাজারে নামিদামী টি স্টোরে হরেক রকমের মসেল্লা ও জর্দা দিয়ে সুস্বাদু পান পাওয়া যাওয়ায় সাধারণ সাদা পানের চাহিদা কমতে থাকায় ঘাড়ে ও হাতে পানের ডালা নিয়ে ফেরিওয়ালা সেজে দোকানে দোকানে খিলি পান বিক্রয় করছেন তিনি।
এভাবে বাজারে ফজর আলী খিলি পান বিক্রি করে আসছেন দীর্ঘ প্রায় ২৫বছর ধরে। জীবনের শেষ প্রান্তেও চলতে থাকে তার জীবিকার্জনের কঠিন সংগ্রাম। এখন তিনি প্রতিদিন বাজারে ২৫ থেকে ৩০টি খিলি পান বিক্রয় করে ৫০টাকা থেকে ৬০টাকা আয় করেন। দিন শেষে সামান্য আয়ের টাকা দিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। কোন কোন দিন ভাত কপালে জুটছে না। যা আয় করেন তা দিয়ে কোনরকমে শরীরে চিকিৎসার পিছনে শেষ হয়ে যায়। এভাবে অসুস্থ শরীর ও সংসার চালাতে অতি কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিবন্ধী ফজর আলীর। তাছাড়া প্রতিবন্ধী ফজর আলীর , দিনে তিন বেলা খাওয়া হয় না। সকালে বাজারে এসে তিনি হোটেল থেকে ২টি রুটি কিনে খান ও ২টি রুটি নিয়ে যান বাড়িতে রাতে খাবার জন্য। দুপুরের খাবার খাওয়া অনেক সময় হয়, আবার হয়না।
কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তবু কাউকে কিছু বলেন না। এদিকে বাজারের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর হোসেন গাইন, আব্দুর রাজ্জাক, আবুল হোসেন, শফিকুল ইসলাম গাউছরা জানান, প্রতিবন্ধী ফজর আলী অসহায় ও গরীব। তিনি বাজারে সৎ ও সততার সাথে পান বিক্রয় করেন। তারা আরও বলেন ফজর আলীর বসবাসের জায়গা নেই, একটি কুড়ে ঘর আছে ছাউনি নেই। বৃষ্টি হলে অন্যের বাড়িতে থাকতে হয়। তারা সবাই বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মহাদ্বয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তবে প্রতিবন্ধী হওয়া স্বত্ত্বেও তিনি কোন ভিক্ষা বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েন নি, এটা একটা উজ্জ্বল নিদর্শন।
ফজর আলী দুঃখের সাথে বলেন, আমার স্ত্রী সন্তান সন্তানাদি নেই। তিন বেলা পেটভরা খাবার খেতে না পারলেও সমাজে আত্মমর্যাদার সাথে বেঁচে আছি, এভাবে মরে গেলেও ভিক্ষা করবো না। তাছাড়া আমি হাটতে চলতে তেমন পারি না,অতি কষ্টের মধ্যো দিয়ে দিন কাটছে আমার। তিনি আরও বলেন, জায়গা জমিতো নেই এই এতিমের যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসাবে একটি ঘর পেতাম তাহলে দুঃখের দিনে শোয়ার জায়গাটা কিছুটা হলেও লাঘব হতো।