জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্ব-সন্দেহ | বাংলারদর্পন 

নিজস্ব প্রতিবেদক :

বহুমুখী সন্দেহ আর অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে বিএনপির সঙ্গে ড. কামাল হোসেন ও ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি. চৌধুরী) ‘জাতীয় ঐক্য প্র্রক্রিয়া’। পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে, এই জোটের ভবিষ্যৎ নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বি. চৌধুরীর বাসায় গত মঙ্গলবার রাতে যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্র্রক্রিয়ার বৈঠকে একটি মোবাইল ফোন কলকে কেন্দ্র করে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য শুরু থেকেই নেতৃত্বের দরকষাকষি, জামায়াত ইস্যু, নির্বাচনে আসন বণ্টন, ঐক্য নিয়ে ২০ দলের শরিকদের অসন্তুষ্টিসহ সব মিলে নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে সরকার বিরোধীদের এই ঐক্য প্রয়াস।

সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর (বি. চৌধুরী) বাসায় মঙ্গলবার রাতে বিশেষ বৈঠকে মিলিত হন যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্র্রক্রিয়া ও বিএনপি নেতারা। বৈঠকটি হওয়ার কথা ছিল ড. কামালের বেইলি রোডের বাসায়। কিন্তু বি. চৌধুরীর সেখানে যেতে অস্বীকৃতিসহ কয়েকটি বিষয়ে মতপার্থক্য দেখা দেয়ায় শেষ পর্যন্ত বি. চৌধুরীর বাসায় বসেন নেতারা। এতে অসন্তুষ্ট হন ড. কামাল। অসুস্থতার কথা জানিয়ে তিনি বৈঠকেই যাননি। ঐক্য জোটের প্রধান দুই নেতার মতানৈক্যের জের ধরে বৈঠকে যোগ দেননি বিএনপির কোনো সিনিয়র নেতাও। পরে দলের পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে পাঠানো হয় ভাইস-চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে। বৈঠক বেশ ঠিকঠাক এগোচ্ছেল। মত-মন্তব্য জানাচ্ছিলেন আমন্ত্রিত নেতারা। একপর্যায়ে বৈঠক স্থগিত করে দেন যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী। এরই মধ্যে বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরীর কাছে বাইরে থেকে কোনো তথ্য আসায় তিনি বৈঠক থেকে বের হয়ে যান। একটু পর আবারো বৈঠক কক্ষে ঢুকে ইশারায় বি. চৌধুরীকে বাইরে ডেকে নিয়ে যান তিনি।

সূত্র জানায়, বাবা-ছেলের কথোপকথন শেষে কক্ষে ঢুকে বৈঠকের ভেতর একটি ফোন লন্ডনে যুক্ত আছে এমন অভিযোগ তুলে বি. চৌধুরী ও মাহী বি. চৌধুরী আমন্ত্রিত নেতাদের মোবাইল ফোন কক্ষের বাইরে রাখার অনুরোধ করেন। এরপর নেতাদের কাছ থেকে প্র্রায় ১০-১২টি ফোন পাশের কক্ষে এনে রাখা হয়। কিছুক্ষণ পরই দ্রুত বৈঠক শেষ করে দেন বি. চৌধুরী। তবে এ নিয়ে বৈঠকে উপস্থিত নেতারা হতভম্ব হয়ে যান।

জামায়াত ছেড়ে দিয়ে তবেই বিএনপিকে ঐক্যজোটে

আসতে হবে জোটের নেতাদের এমন শর্ত বেশ পুরনো। গত ২২ অক্টোবর নাগরিক সমাবেশে নেতারা হাতে হাত রেখে একসঙ্গে পথচলার অঙ্গীকার করার পরও অমীমাংসিত রয়ে গেছে জামায়াত ছাড়ার ইস্যুটি। বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াতকে পুরোপুরি ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে চ‚ড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত পাচ্ছেন না জোটের নেতারা। এ বিষয়ে প্র্রবল আপত্তি তুলেছেন বিকল্পধারার চেয়ারম্যান বি. চৌধুরী। এবার বিএনপির নেতাদের ‘ফাইনাল আল্টিমেটাম’ দেয়া হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে। বিএনপিসহ বৃহত্তর ঐক্যের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি দল ও শীর্ষ নেতাদের লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, ঐক্য প্র্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে হলে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে আসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বি. চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের বৃহত্তর এই ঐক্যে স্বাধীনতাবিরোধী কেউ থাকতে পারবে না। কেবলমাত্র স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পক্ষের সবাইকে নিয়ে এই ঐক্য হবে। এ ব্যাপারে বৈঠকে আমাদের মধ্যে মতৈক্য হয়েছে। অবশ্য বিএনপি এ নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেনি। দলের নেতারা বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত সঙ্গে রাখারই কথাই বলেছেন। তবে আগামী শনিবার দলের জনসভায় জামায়াত ছাড়া না ছাড়ার বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

প্রকাশ্যে না বললেও শুরুতেই ‘জাতীয় ঐক্যের’ প্রধান নেতা কে হবেন, তা নিয়ে ড. কামাল ও বি. চৌধুরীর সৃষ্টি হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের কারণেই মঙ্গলবারের বৈঠকে তারা দুজন দুজনকে কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। জানা গেছে, বিএনপির পক্ষ থেকে বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বলা হয়েছে, তার প্রতি তাদের সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকবে। অতীতের সব ভুল বোঝাবুঝির অবসান চায় দলটি। তবে ঐক্য প্রক্রিয়ার প্রধান নেতা হিসেবে ড. কামাল হোসেনকেই দেখতে চায় বিএনপি। দলীয় নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পুরো বিষয়টিই খোলাসা করেছেন কামাল হোসেনের কাছে। এমনকি ঐক্যের অগ্রগতি নিয়ে মঙ্গলবার ড. কামালের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেছেন মির্জা ফখরুল। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে একমঞ্চে আনার বিষয়ে বেশ কিছুক্ষণ একান্তে আলাপ করেন দুই নেতা। কিন্তু বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষোভে ফুঁসতে থাকেন বি. চৌধুরীর ছেলে মাহী বি. চৌধুরী। তার অভিযোগ, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তার বাবার যেখানে উপস্থিতি নেই সেখানে তাদের গুরুত্বহীন হিসেবেই ধরা হচ্ছে।

অন্যদিকে সরকারবিরোধী বহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া একধাপ এগিয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে এমন দাবি করা হলেও এতে ঘোর আপত্তি ২০ দলের শরিকদের। এই ইস্যুতে জোট নেতাদের সঙ্গে বিএনপির বিভাজন বাড়ছে। গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক জোট ঐক্য প্রক্রিয়ার নাগরিক সমাবেশে যোগ দেননি ২০ দলের অনেক নেতাই। এ নিয়ে ২০ দলের নেতারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ঐক্যের রাজনীতিতে বিএনপি কোনোদিনও সফল হয়নি আগামীতেও হতে পারবে না। নতুন জোট করে বিএনপি ২০ দলকে এক অর্থে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। নেতারা বলেন, ২০ দলে ইতোমধ্যে বিভাজন হয়ে গেছে। ২০টি চেয়ারের সঙ্গে যদি আরো ১০টি চেয়ার যোগ হয় তবে আমাদের গুরুত্ব কতোটা থাকে সেটা নতুন করে ভাবতে হবে।

জানতে চাইলে ন্যাপ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি বলেন, আমরা ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে আছি। বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে বিএনপি জোটের প্রতিনিধিত্ব করছে। এ বিষয়ে আমরা তেমন অবগত নই। আমাদের সেখানে কোনো গুরুত্বও নেই। আমরা ২০ দলকে প্রাধান্য দিতে চাই। তাহলে ২০ দলীয় জোটের মধ্যে বিভাজন তৈরি হলো কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০ দলের সর্বশেষ যে বৈঠক হয়েছে সেখানে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত হয়েছি। বিএনপি শেষ মুহূর্তে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা আমন্ত্রণ পাইনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *