সাতক্ষীরায় চলছে ৩শ’ বছরের প্রাণের গুড়পুকুর মেলা

শেখ আমিনুর হোসেন,সাতক্ষীরা: মেলা বা গুড়পুকুর মেলা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী মেলা, যার বয়স প্রায় ৩০০ বছর বলে অনুমিত হয়। সাধারণত সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল স্কুলের মাঠ আর পলাশপোল গ্রামই হলো মেলার মূল কেন্দ্রস্থল। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ভাদ্র মাসের শেষে অনুষ্ঠিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এই মেলা একমাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলার আবহমান কালের সকল গ্রাম্য মেলার মতোই এই মেলায়ও বিভিন্ন জিনিসের পসরা বসে। কাঠ, মাটি, বাঁশ, বেত আর লোহার সামগ্রীতে ঠাসা এই মেলার প্রধান আকর্ষণ থাকে সাতক্ষীরার নানা প্রজাতির কলম-করা-গাছগাছড়া ঢাকা, ফরিদপুর,বাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসেন স্টেশনারী পণ্যের বিক্রেতারা। কলম-করা-চারা আর আসবাবপত্র ছাড়াও মেলায় থাকে শিশুদের বিভিন্ন খেলনা; থাকে বিভিন্ন মৌসুমী ফল, থাকে গৃহস্থালী উপকরণ (ঝুড়ি, ধামা, কুলা, বাটি, দেলকো, শাবল, খোন্তা, দা, ছুরি, কোদাল প্রভৃতি)। এছাড়া বিনোদনের জন্য থাকে নাগোরদোলাসহ বিভিন্ন আয়োজন; সার্কাস, যাদু প্রদর্শনী, পুতুল নাচ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। একসময় কলকাতা, ও লন্ডন থেকে ব্যবসায়ীরা এই মেলায় আসতেন।

বর্তমানে সাতক্ষীরা পৌরসভা ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসবকে কেন্দ্র করে এই মেলা অনুষ্ঠিত হলেও সাতক্ষীরা শহরবাসীর জন্য এই মেলা হয়ে উঠছে গরিব-ধনী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক মিলনমেলা।

প্রতিবছর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ভাদ্র মাসের শেষদিনে অনুষ্ঠিত হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মনসা পূজা। এই পূজাকে কেন্দ্র করে ৩০০ বছরের বেশি সময় ধরে সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এই ‘গুড়পুকুরের মেলা’। তবে কে বা কারা মেলাটির গোড়াপত্তন করেছিলেন তার কোনো ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া যায় না।

তবে জনশ্রুতি রয়েছে শহরের পলাশপোলে একটি গোলাকৃতির পুকুরের পাড়ে বট গাছের নিচে একবার এক ক্লান্ত পথিক বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। গাছের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ পথিকের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছিলো দেখে এসময় একটি বিষধর সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দেয়। পথিক এই দৃশ্য দেখে হিন্দু ধর্মমতানুসারে মনসার উদ্দেশ্যে পূজা দেওয়া শুরু করেন অথবা এলাকার লোকজনকে মনসা পূজা করতে বলেন। এই পূজার মিষ্টি প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেওয়ায় পুকুরের পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এই বিশ্বাস থেকে গোলাকৃতি পুকুরের নাম হয়ে যায় গুড়পুকুর। সেই থেকে শুরু হয় গুড়পুকুরের মেলা। এলাকার প্রবীণেরা তাদের বাল্যকাল থেকেই এ মেলা দেখে আসছেন বলে জানা যায়।

তবে গুড়পুকুর নামকরণের অন্যান্য অভিমতও রয়েছে, যেমন: কারো মতে পুকুরে মনসা পূজার বাতাসা ফেলা হতো আর ঐ বাতাসার জন্য পুকুরের পানি মিষ্টি লাগতো বলেই এধরণের নামকরণ। কারো মতে, পুকুরটিতে পানি থাকতো না বেশিদিন; পরে স্বপ্নে দেখা গেলো পুকুরে ১০০ ভাড় গুড় ঢালতে হবে, আর সেমতে কাজ করার ফলেই পুকুরে পানি এলো, তাই এই নামকরণ। আবার শোনা যায়, পুকুরের তলদেশ থেকে একসময় মিষ্টি পানি উঠতো বলে এমন নামকরণ। কারো মতে পুকুরের পাড়ে একসময় প্রচুর খেজুর গাছ হতো। একবার সব গাছের রস সংগ্রহ করে তা দিয়ে গুড় তৈরি করে তার বিক্রীত মূল্যে খনন করা হয় এই পুকুর। আর সেই থেকেই এই পুকুরের নাম গুড়পুকুর। তবে ঐতিহাসিক আবদুস সোবহান খান চৌধুরীর মতে, চৌধুরীপাড়ার রায় চৌধুরীরা গৌরবর্ণের ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাই তাদের পুকুরকে বলা হতো গৌরদের পুকুর। সেই ‘গৌরদের পুকুর’-ই কথার বিবর্তনে হয়ে যায় ‘গুড়পুকুর’।

মেলাটি আবহমান কাল ধরে চলে এলেও ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলা চলাকালে শহরের একটি সিনেমা হল আর সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে সার্কাসের প্যান্ডেলে বোমা হামলা করে জঙ্গীরা। এই ঘটনায় ৩ জন নিহত হয়, আহত হয় শতাধিক নারী-পুরুষ আর শিশু। এর ফলে ৬ বছর ধরে মেলা পরিচালনার অনুমতি না পাওয়ায় মেলা বন্ধ ছিলো।

গত ২১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে সাতক্ষীরা শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে ১ মাস ব্যাপী বর্ণিল এ মেলার উদ্বোধন করে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ। এ বারের মেলায় অশ্লীল নৃত্য, জুয়া খেলা, হাউজি ও লটারি খেলাকে স্থানীয় প্রশাসন নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি যাত্রাও সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *