বাংলা নববর্ষের ইতিহাস ও ব্যাপ্তি

বাংলারদর্পন >>>

জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সব বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ, এ কথা আমাদের মিডিয়া বড় করে প্রচার করে। আমরা তা শুনে শুনে বড় হচ্ছি। পয়লা বৈশাখ অবশ্যই বাঙালির প্রাণের উৎসব এবং প্রধান অসাম্প্রদায়িক উৎসব

কিন্তু অনেকেই জানে না যে এর ব্যাপ্তি আরও অনেক বড়।

যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৫৭ বছর আগে ভারতবর্ষের সম্রাট বিক্রমাদিত্য প্রবর্তন করেন বিক্রম সাম্বাত পঞ্জিকা। তিনি হিন্দু রাজা ছিলেন বলে এবং হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল এই পঞ্জিকা মেনে চলে বলে আন্তর্জাতিক মহলে এটি হিন্দু পঞ্জিকা বা ক্যালেন্ডার হিসেবেও পরিচিত। অনেকে এটিকে নেপালি ক্যালেন্ডারও বলেন। বিক্রম সাম্বাত পঞ্জিকাই আমাদের বাংলা পঞ্জিকা। রাজা শশাঙ্কের শাসনামলে, ৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে, বাংলা সাল গণনা শুরু হয়, তত দিনে বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারের বয়স ৬৫০ বছর হয়ে গেছে। যখন বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারের সূচনা হয়, তখন লিখিত ফরমে বাংলা ভাষা ছিল না। ছিল সংস্কৃত ভাষা। ঠিক যে সময়টাতে বাংলা ভাষার লিখিত ফরম তৈরি হয়, তখনই বাংলা ক্যালেন্ডারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে, এটি কোনো মৌলিক আবিষ্কার ছিল না। বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারকেই বাংলায় লেখা হয়। মাসের নামগুলোও অবিকল তাই আছে।

বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশগুলো, যেমন: মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, ভুটান, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশও একই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে, অর্থাৎ বৈশাখ মাসের ১ তারিখে নববর্ষ উদ্যাপন করে। ওরা এটিকে বলে বৌদ্ধ পঞ্জিকা এবং এর জন্ম বিভিন্ন দেশে কিছুটা ভিন্নতাভেদে যিশুর জন্মের ৫৪৫ থেকে ৫৪৩ বছর আগে। অর্থাৎ বিক্রম সাম্বাত ক্যালেন্ডারের চেয়েও বৌদ্ধ ক্যালেন্ডার আরও ৪৮৮ বছরের পুরোনো। বৌদ্ধ পঞ্জিকা, বিক্রম সাম্বাত পঞ্জিকা কিংবা বাংলা পঞ্জিকা, প্রকৃতপক্ষে একই পঞ্জিকা। সব পঞ্জিকাতেই বৈশাখ, জ্যেষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র—এই নামেই বারো মাসের নাম রয়েছে।

পয়লা বৈশাখ তাই শুধু বাঙালির নববর্ষ নয়, এটি পুরো দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নববর্ষ। বাংলাদেশের সব আদিবাসী এই পঞ্জিকা অনুসরণ করে এবং এটি তাদেরও নববর্ষ।

পাল থেকে সেন, সেন থেকে নানান চড়াই–উতরাই পেরিয়ে মুসলিম মুঘল সম্রাটদের হাতে চলে যায় ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা। মুঘলরা ক্ষমতায় এসে ইসলামিক বা আরবি ক্যালেন্ডার “হিজরি” অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহির উদ্দিন মুহম্মদ বাবর এবং তাঁর পুত্র দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন হিজরি সাল অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করলেও, তৃতীয় মুঘল সম্রাট জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর চান্দ্র মাসিক ক্যালেন্ডার পাল্টে বাংলা ক্যালেন্ডার পুনঃস্থাপন করেন।

হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসভিত্তিক হওয়ায় ৩৫৪/৩৫৫ দিনে বছর হয়, যা সৌরবছরের (৩৬৫/৩৬৬ দিনে বছর) চেয়ে ১০/১১ দিন ছোট। ফলে হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী একই মাস ঘুরে ঘুরে কয়েক বছর পরে ভিন্ন ঋতুতে আসে। এতে করে কৃষকদের খাজনা দিতে অসুবিধায় পড়তে হয়। কারণ, কৃষকেরা ফসল বিক্রি করে খাজনা দেন। চান্দ্র মাসের বছর একেক সময় একেক ঋতুতে শেষ হয় বলে তখন ফসল তোলার কাল ঠিক থাকে না। এই অসুবিধা দূর করার জন্য বিচক্ষণ সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ সিরাজিকে হিজরি চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌরবর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। এভাবেই সৌরবর্ষপঞ্জি বাংলা পঞ্জিকার নবযাত্রা শুরু হয়।

অধিবর্ষ (প্রতি চার বছরে এক দিন বেড়ে যাওয়া, অর্থাৎ ৩৬৬ দিনে বছর হওয়া) সংক্রান্ত একটি জটিলতা ছিল মূল পঞ্জিকায়। ফলে ইংরেজি তারিখের সঙ্গে বাংলা তারিখের মিল রাখা যেত না। যেমন এ বছর ৮ ফাল্গুনে ২১ ফেব্রুয়ারি হলো তো অন্য বছর ৯ ফাল্গুনে ২১ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে। এই সমস্যা দূর করতে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি ফাল্গুন মাসকে অধিবর্ষ ঘোষণা করেন। সংস্কারের ফলে এখন মাস গণনা করা হয় এভাবে—বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত এই পাঁচ মাস হবে ৩১ দিনে, আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত এই সাত মাস হবে ৩০ দিনে, তবে প্রতি চার বছর পরপর ফাল্গুন মাস হবে ৩১ দিনে (যে বছর ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে হবে)।

পৃথিবীতে ১৯৬টি দেশ আছে, কিন্তু খুব কম দেশেরই নিজের একটি পঞ্জিকা আছে। সেই দিক থেকে আমরা সৌভাগ্যবান যে আমাদের নিজস্ব একটি পঞ্জিকা আছে। আছে একান্ত আমার নিজের নববর্ষ। যে কয়টি সৌভাগ্যবান দেশের নিজস্ব পঞ্জিকা রয়েছে, তারা খুব ঘটা করেই নিজের নতুন বছরের আগমনকালকে উদ্যাপন করে।

বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। এ দেশের সহজ-সরল গ্রামবাসী আবহমানকাল ধরে বছরের শেষ দিনকে ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ হিসেবে পালন করে আসছে। এই দিনে গ্রামে গ্রামে মেলা হয়, নাগরদোলা বসে, পুতুলনাচ হয়, যাত্রাপালা হয়, অর্থাৎ উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর বিপুল আয়োজনে মেতে ওঠে সারা দেশের মানুষ। যেহেতু এটি বাংলা নববর্ষ, তাই বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য দিয়ে রাঙানো হয় এই উৎসব। খাজনা দিয়ে যেমন বছরের শেষ দিনে সরকারের কাছ থেকে দায়মুক্ত হয় মানুষ, তেমনি যাবতীয় বকেয়া পরিশোধ করে ব্যবসায়ীদের (দোকানিদের) কাছ থেকেও দায়মুক্তির দিন এটি। প্রতিটি ব্যবসায়ী তাই এই দিন ‘হালখাতা’ খুলে বসেন। অর্থাৎ তাঁরা বকেয়ার খাতাটি হালনাগাদ করে নেন। একে একে দেনাদারেরা আসেন, দেনা পরিশোধ করেন, দোকানিরা তাঁদের মিষ্টি পরিবেশন করেন, কোলাকুলি করেন। এভাবে একটি আনন্দঘন এবং উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে অতীতের সব দায়দেনা মিটিয়ে নতুন বছরের যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের মানুষ।

পাকিস্তান সরকার ছিল বাংলাবিদ্বেষী। তাদের ধারণা ছিল বাংলা হিন্দুদের ভাষা। পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত চর্চা তারা নিষিদ্ধ করে। এই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৬৭ সালে ছায়ানটের শিল্পীরা পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে সমবেত হয়ে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’—এই রবীন্দ্রসংগীতটি পরিবেশন করেন। সেই থেকে ঢাকায়, রমনার বটমূলে, নববর্ষ উদ্যাপনের প্রথা শুরু হয়, যা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে বড় শহরগুলোতে। যেহেতু এটি ঐতিহ্যের সমারোহ ঘটানোর দিন, তাই ধীরে ধীরে এই উৎসবে যুক্ত হয় পান্তা-ইলিশ, নানান রকমের ভর্তা, পিঠা-পায়েস।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট ১৯৮৯ সালে এর সঙ্গে যুক্ত করে মঙ্গল শোভাযাত্রা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *