আর্থিক খাতের বিপর্যয়ের দায়দায়িত্ব কার ? 

 

গোলাম মাওলা রনি  >>

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের বিপর্যয় নিয়ে দায়িত্ববানদের দায়িত্বহীন কথাবার্তা শুনলে মন-মেজাজ ঠিক রাখা দায় হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ ও অঙ্গভঙ্গি দেখলে মনে হয় আমাজন অথবা আফ্রিকার গভীর জঙ্গল থেকে একদল দঙ্গল মামদো ভূত এসে আমাদের দেশের ব্যাংক, বীমা, শেয়ারবাজারসহ অন্যান্য আর্থিক খাতের সর্বনাশ ঘটিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তারা বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকে এলোমেলো বক্তব্য দেন এবং নানা ধরনের উল্টাপাল্টা বিপরীতমুখী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে একটার পর একটা বিপর্যয় সৃষ্টি করেই চলেছেন। এ ব্যাপারে আবার পরবর্তী সময়ে তাদেরকে কেউ প্রশ্ন করলে তারা মুখের ওপর বলে দিচ্ছেন- আমরা তো দায়ী নই; অমুকে দায়ী অথবা তমুকে একাই পুরো একটা সরকারি ব্যাংক সাবাড় করে দিয়েছেন।

 

সম্প্রতি জনতা ব্যাংক কেলেঙ্কারি, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি এবং আদিকালের শেয়ারবাজার, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ ইত্যাদি যুগান্তকারী কেলেঙ্কারিগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকা তেমন একটা নেই।লোকজন ব্যাংকে টাকা রাখার পরিবর্তে জায়গাজমি, ফ্লাট-দোকান ক্রয় ইত্যাদিতে বিনিয়োগের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র কিনে অথবা নিজেদের কাছে স্বর্ণ অথবা নগদে অর্থকড়ি সঞ্চয় করে রাখছে। দেশের রুগ্ণ অর্থনীতির জন্য জনসাধারণের এ ধরনের আস্থাহীনতা অনেকটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। বছরখানেক আগে সরকার দেশের অর্থনীতির অবস্থা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে অতি স্থিতিশীল প্রদর্শন করার জন্য তড়িঘড়ি করে ব্যাংক আমানতের সুদের হার মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাজারে ডলার এবং বাংলাদেশী টাকার জোগান ও সরবরাহের ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে এক বছরের মাথায় পুরো ব্যাংকখাত ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক খাতের আমানত সংগ্রহ ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। এখন ব্যাংকগুলো তিন মাস আগে আমানতের জন্য যে সুদহার নির্ধারণ করেছিল- তার প্রায় পৌনে দুই গুণ সুদ দিয়েও নতুন আমানত সংগ্রহ করতে পারছে না।

 

বাংলাদেশের সব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, লিজিং কোম্পানিসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আমানত সংগ্রহের জন্য অতিরিক্ত সুদ দেয়ার কথা বলে যেভাবে কামড়াকামড়ি শুরু করেছে, তা আগামী দিনে হয়তো নতুন কোনো ভয়ঙ্কর আর্থিক কেলেঙ্কারি অথবা মারাত্মক কোনো অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। উন্নত বিশ্বের অর্থবাজারে বাংলাদেশের মতো সমস্যা সৃষ্টি হলে সরকারি মদদে ব্যাংকের সংখ্যা রাতারাতি কমিয়ে ফেলা হতো কয়েকটি ব্যাংককে একীভূত করার মাধ্যমে। এই কাজের মাধ্যমে উন্নত দেশগুলোর সরকার আমানত সংগ্রহের অসম প্রতিযোগিতা, নগদ অর্থের সঙ্কট এবং ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনাকে চমৎকারভাবে সমন্বয় করে দিত।

 

বিশ্ব অর্থনীতির প্রচলিত নিয়মকানুনকে তোয়াক্কা না করার কারণে আমাদের শেয়ারবাজার, মুদ্রাবাজার, ব্যাংক ও বীমা শিল্পসহ অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তলে তলে কতটা রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তা যদি পুরোটা প্রকাশ হয়ে পড়ে তবে পুরো জাতির পক্ষে সেই দায় সামাল দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে অর্থ চুরি করে দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বিদেশে রাজরাজড়াদের মতো বিলাসী জীবনযাপন অথবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থেকে দেশের মাটিতে সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বুক ফুলিয়ে চলার যে উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ে রীতিমতো অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে বিশ্ব দুর্নীতির মাইলফলকে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য না করেও মহলবিশেষের মদদে ভিআইপি অথবা সিআইপি মর্যাদা নিয়ে দেশের বড় বড় বাণিজ্যিক সংগঠন, চেম্বার অথবা ফেডারেশনের নেতৃত্বে এমনসব লোক বসে আছেন, যাদেরকে দেখলে ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসায়ী পরিচয় দিতে রীতিমতো অপমানবোধ করেন। এই শ্রেণীর তথাকথিত ব্যবসায়ী নেতারা দলবেঁধে প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরের সঙ্গী হন এবং সেই কাহিনীকে পুঁজি করে পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহলে তদবির-বাণিজ্য করে সর্বমহলের বারোটা বাজিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, গণমাধ্যম অথবা আইন প্রয়াগকারী সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই এসব লোককে চেনেন; কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ টুঁ-শব্দটি উচ্চারণ করেন না। অথচ এসব লোকের তদবির-বাণিজ্যে বিভ্রান্ত হয়ে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যখন বড় রকম ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে তখন আমরা দশ গলায় আহাজারি শুরু করি।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক কোন বিচারে প্রাইভেট ব্যাংকের অনুমোদন দেয় তা আমার জানা নেই। ‘ক’ লিখতে কলম ভাঙেন অথবা ব্যাংকিংয়ের ‘ব’ বোঝেন না, এমন লোক কী করে ব্যাংকের মালিক, পরিচালক বা চেয়ারম্যান হয়ে বসেন তা আমার বোধগম্য হয় না। গত দশ বছরে সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যাদেরকে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক অথবা চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে কতজনের ব্যাংক পরিচালনার দক্ষতা ছিল বা আছে ঢাকা শহরে ভাতের হোটেল চালায়, ফার্মেসির দোকান দেয়, কোনো উকিলের চেম্বারে মুহুরিগিরি করে অথবা কোনো মফস্বল এলাকায় সরকার সমর্থক রাজনৈতিক দলের তেলবাজ তৃতীয় স্তরের নেতাদেরকে যারা ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বা হবে না তা আমি বুঝতে পারি না।

 

সাম্প্রতিক দেশের একটি শীর্ষ গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছে, গাড়ি চোর চক্রের হোতা কী করে ব্যক্তি ও মহলবিশেষের রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে একটি সরকারি ব্যাংক থেকে নিয়মবহির্ভূতভাবে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়ে গিয়েছেন। ওই বিষয়ে অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি দায় এড়ানোর জন্য বলেন, ব্যবসায়ীরা একটু বেশিমাত্রায় লোভী। মন্ত্রীর এই বক্তব্য তার জন্য কতটা হিতকর তা হয়তো তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ব্যবসায়ী সমাজ মন্ত্রীর বক্তব্যকে যে ভালোভাবে নেয়নি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতে, অর্থমন্ত্রী একটি অস্থির সময় পার করছেন। তার নিজ দলের অনেকে প্রকাশ্যে তার পদত্যাগ দাবি করে সংসদে এবং সংসদের বাইরে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন। অন্য দিকে সংসদের তথাকথিত বিরোধী দলও অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগের ব্যাপারে জোরালো বক্তব্য রেখে চলেছে। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে কি না জানি না- অর্থমন্ত্রী হঠাৎ করে ঘোষণা দিলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের পর তিনি আর দায়িত্ব পালন করবেন না। তার এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রীর বিরোধীরা সকৌতুকে বলতে আরম্ভ করলেন, ডিসেম্বর তো অনেক দেরি আমাদের যে ত্বর সইছে না- আপনি এখনই পদত্যাগ করুন!

 

আমরা অনেকেই জানি, আমাদের অর্থমন্ত্রীর কথায় মন্ত্রণালয়ের সব বিভাগ ও অনুবিভাগ চলে না। কিছু বিভাগ রয়েছে, যেখানে মন্ত্রী যা বলেন বাস্তবে তার উল্টো হয়। এমনকি সচিবালয়ে খোদ মন্ত্রীর দফতরেও মাঝে মধ্যে মন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিনব ঘটনা দেখতে পাওয়া যায়। মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরে মন্ত্রীর ক্ষমতার বলয় ও দৌরাত্ম্য কতটুকু তা বোঝার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে মন্ত্রী কর্তৃক ঢাকঢোল পিটিয়ে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে সদ্য অবসরে যাওয়া অর্থসচিব ও মন্ত্রীর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত হেদায়েত আল মামুনের নিয়োগ এবং গভীর রাতে মন্ত্রীর অজান্তে সেই নিয়োগ বাতিল হয়ে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের তেলেসমাতির কাহিনীটি আলোচনা করা যেতে পারে। দেশবাসী খুব ভালো করেই জানেন, আলোচিত এবং সাম্প্রতিক সময়ে সমালোচিত ও নিদারুণভাবে বিতর্কিত অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত যখন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন তখন তিনি মন্ত্রী, মন্ত্রণালয় কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক কিছুই পাত্তা দিতেন না। আবুল বারকাত দীর্ঘ দিন ধরে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী হিসেবে দলের পক্ষে সরব থেকেছেন এবং আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে নানামুখী প্রচার-প্রপাগান্ডা চালিয়েছিলেন।

 

আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা মনে করতেন, আবুল বারকাত অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর নেক নজরে আছেন। ফলে তিনি হয় অর্থমন্ত্রী কিংবা নিদেনপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হবেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করল, তখন দেখা গেল জনাব বারকাত মন্ত্রী বা গভর্নর না হয়ে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান হলেন। এর ফলে দুটো প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেল। প্রথমত, আবুল বারকাত অর্থমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ে ব্যাংক চালাতে শুরু করলেন এবং দ্বিতীয়ত, অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এক চুল পাত্তা না দিয়ে স্বাধীনভাবে এবং ইচ্ছেমতো জনতা ব্যাংক চালিয়ে বর্তমানের বেহাল দশায় পরিণত করলেন। অন্য দিকে, অর্থমন্ত্রী ও তৎকালীন গভর্নর অজ্ঞাত কারণে চুপচাপ থেকে জাতির গলায় বিরাট এক আর্থিক কেলেঙ্কারির পুষ্পমাল্য কাম-ফাঁস পরিয়ে দিলেন।

 

জনতা ব্যাংকের তৎকালীন কিংবা বর্তমান চেয়ারম্যানের মতো অন্যান্য ব্যাংকের বিশেষ করে বেসিক ব্যাংকের আবদুল হাই বাচ্চুর ওপর মন্ত্রীর যে একরত্তি পরিমাণ প্রভাব ছিল না তা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত। একইভাবে জনাব আতিউর যখন গভর্নর ছিলেন তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর মন্ত্রীর কর্তৃত্ব ছিল না। এ ছাড়া এনবিআর বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যে মন্ত্রীর কথায় চলা তো দূরের কথা এক চুলও নড়ে না, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি নজিবুর রহমান যখন সংস্থাটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এনবিআর চেয়ারম্যানের সাথে মন্ত্রীর দ্বন্দ্ব এতটাই প্রকট হয়েছিল যে, মন্ত্রী প্রকাশ্যে ডেটলাইন দিয়ে নজিবুর রহমানের ওএসডি করার ঘোষণা দিলেন। অন্য দিকে, নজিবুর রহমান তার মদদদাতাদের কল্যাণে নিজ পদে বহাল থেকে পুরো মেয়াদ দাপটের সাথে পার করলেন এবং পুরস্কারস্বরূপ চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন চুক্তির অধীন সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে যোগ দিলেন।

 

বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের উল্লেখিত হালহকিকত পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই অনুধাবন করা সম্ভব, আর্থিক খাতের বিপর্যয়ের প্রকৃত কারণ কী এবং এসব বিপর্যয়ের দায়দায়িত্ব কার। আমাদের মান্যবর এবং বয়োজ্যেষ্ঠ পণ্ডিত অর্থমন্ত্রীর ভালোমানুষী এবং অসহায়ত্বের জন্য আমরা অনুশোচনা করতে পারি কিংবা দুঃখ প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু জীবনের শেষ ফ্লাইটের ট্রানজিট পয়েন্টে বসে কেন সারা জীবনের সফল একজন মানুষ ক্ষমতার মোহে নিজেকে অসহায়ত্বের মধ্যে বন্দী রেখে মাঝে মধ্যে সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো অস্থিরভাবে নানান মনোহরী, কৌতুকময় ও রস সঞ্চারক কথাবার্তা বলে জাতিকে বিনোদন জোগাবেন, তার হিসাব কিছুতেই মেলাতে পারি না।

লেখক – সাবেক সংসদ সদস্য ও কলামিস্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *