বেঁদে সম্প্রদায়ের এক বিচিত্র জীবন ও জীবিকা

আবদুল্লাহ রিয়েল ,ভোলা থেকে ফিরে:

 

2-2
নৌকায় খাওয়া, নৌকায় ঘুম; নৌকায় চলে পড়ালেখা। চলে রান্নাবান্নার মতো সাংসারিক কাজকর্ম। কত বিচিত্র তাদের জীবন! জীবন যেন ভিন্ন এক ছকে বাঁধা। যেকোনো গল্প-নাটককে হার মানাবে তাদের বাস্তব জীবনের গল্প। তবুও বেঁচে থাকার সংগ্রামে থেমে নেই তাদের জীবন। এমনই বিচিত্র জীবন যাপন করছেন ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার মায়াব্রীজ সংলগ্ন খালে পানির ওপর ভাসমান অবস্থায় বসবাসকারী এসব পরিবার। নানা প্রতিকূল অবস্থায় সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নতুন কোনো স্বপ্ন কিংবা নতুন জীবনের জন্য।
এছাড়াও ভোলা হেলিপ্যাড, বোরহানউদ্দিন হেলিপ্যাড, লালমোহন শাহবাজপুর কলেজ গেইট, চরফ্যাশন হেলিপ্যাড ও চরফ্যাশন পূর্ববাজার লঞ্চঘাট খালে বেঁেদ পরিবারগুলোকে অস্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেখা গেছে ।
মুসলিম নিয়মে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করলেও তাদের বিয়ের আনুষ্ঠাকিতা ভিন্ন। জাতি বৈষ্যমের কারনে এখানের বেঁদে সম্প্রাদায়ের শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। আধুনিকতার এতটুকু ছোঁয়া লাগেনি এ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। তথ্য-প্রযুক্তির ডিজিটাল বাংলাদেশে সাথে তারা খুবই অপরিচিত। প্রচলিত, আধুনিক ও প্রযুক্তিগত-কোন শিক্ষাই তারা এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। দেশের নাগরীক হিসেবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করার অধিকার থাকলেও নাগরিক সুবিধা ভোগ করার অধিকার যেন তাদের নেই। অন্যান্য মানুষের মতো সামাজিক মর্যাদায় জীবন-যাপন করা তাদের খুবই ইচ্ছে। কিন্তু সামাজিক বৈষম্য তাদের প্রধান অস্তরায় হয়ে দাড়িঁয়েছে। যে কারনে শত প্রতিকুলতার সাথে যুদ্ধ করে সম্প্রদায় ভিত্তিক পেশার উপর ভর করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে তারা।
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী এখানের বেঁেদ বাসিন্দারা সম্প্রদায় ভিত্তিক পেশাতেই জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এখানে বেশির ভাগ পুরুষ সদস্য পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন মাছ ধরাকেই। মেঘনা নদী ও খাল-বিলই তাদের মাছ ধরার প্রধান উৎস। মাছ বিক্রি করেই চলে তাদের সংসার। পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েরাও বিভিন্ন ধরনের পেশায় জড়িত। কেউ প্রসাধনসামগ্রী ফেরি করে বিক্রি করেন গ্রামে গ্রামে। আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ধরনের কাপড়ও বিক্রি করে থাকেন।
আবার অনেকে মেলামাইনের জিনিস বিক্রি করেন। ঝাড়-ফুক, শিঙ্গা লাগানো ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করা বেঁদেনীদের প্রধান পেশা। সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করা সম্প্রদায়ের পুরুষদের পেশা। হাটতে পারা শিশুদের দিয়েও তারা সাপ খেলা দেখানোর মতো ঝুঁকি কাজ প্রশিক্ষন দিয়ে থাকে। যাতে শিশুরা বড় হয়ে জাতিগত পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। এখানকার শিশুরা স্কুলে শিক্ষা ছাড়াই বেড়ে উঠছে। উন্নত স্বাস্থ্যসেবা না পেলেও নিজস্ব দাওয়াই দিয়েই চলে চিকিৎসাব্যবস্থা। মোট কথা, মানুষের মৌলিক যে চাহিদা তা এখানে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। বর্তমানে তাবিজ-কবজে মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলায় অন্য পেশায়ও ঝুকে পড়ছে তারা।
বেঁদে পরিবারের সত্তরোর্ধ্ব ময়ফুল বেগম বাংলার দর্পন কে জানান, জীবনের নানা তিক্ততার কথা। যে নৌকায় তাদের বসবাস, সামান্য ঝড় হলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয় সবার। সবচেয়ে অনিরাপদ অবস্থার মুখে পড়ে শিশু ও বৃদ্ধ মানুষেরা। তাই ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করলে তাদের জীবনে নেমে আসে এক অমানিশা অন্ধকার। আর ঝড় কেটে গেলে ফিরে পায় নতুন জীবন। তারা জানান, তাদের এ জীবন আর ভালো লাগে না।

সম্পাদনা/  জুলফিকার মাসুদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *