বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস আজ : কর্মক্ষেত্রে পাঁচজনে একজন মানসিকভাবে অসুস্থ

 

বাংলার দর্পন ডটকম – ১০ অক্টোবর ২০১৭।

চাকরিজীবী রুমন হক পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল। তবে কর্মক্ষেত্রে এর স্বীকৃতি নেই। ছোটখাটো বিষয়ে বসের ভর্ৎসনা শুনতে হয়। বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব হবে জেনেও কর্মক্ষেত্রে বেশি সময় দিতে শুরু করেন রুমন। কিন্তু বসের সন্তুষ্টি মেলেনি। হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগতে শুরু করেন তিনি। মাস তিনেক আগে বসের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে চাকরি হারান।

চাকরি হারানোর পর দুবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন রুমন। এখন মানসিক রোগের চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁর চিকিৎসক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপ, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও হতাশায় রুমন মানসিক রোগে আক্রান্ত। মেজাজ হারিয়ে চাকরি খোয়ানোর পাশাপাশি তাঁর পারিবারিক কলহ বেড়েছে। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’

এমন পরিস্থিতির শিকার রুমন হক একা নন। গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাঁদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ কাজ হারান। এসব মানুষ অনুপস্থিতি, কর্মদক্ষতা হ্রাস, কাজে কম মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং মনে রাখার সমস্যায় ভোগেন।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথের (ডব্লিউএফএমএইচ) ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০১৭ উপলক্ষে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

ডব্লিউএফএমএইচের প্রতিবেদনে বলা হয়, মানসিক রোগের উল্লেখযোগ্য কারণ কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ। বিশ্বায়ন ও পুঁজিবাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। আর এতে সৃষ্ট কাজের চাপে কর্মীরা বিষণ্নতাসহ নানা মানসিক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অতিরিক্ত পরিশ্রম, কম পারিশ্রমিক, কর্মী ছাঁটাই, কর্মক্ষেত্রে অসন্তুষ্টি, সহকর্মীদের অসহযোগিতা, দারিদ্র্য ও সামাজিক অবস্থান হারানোর ভয়ে মূলত কর্মীরা বিষণ্নতায় ভোগেন। প্রতিবেদন অনুসারে, কর্মক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কাজে মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও মনে রাখার সমস্যায় ভোগেন। এতে একজনের গড়ে বছরে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়।

বাংলাদেশের কোনো নির্দিষ্ট গবেষণা না থাকলেও চিত্র কম-বেশি একই। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক মেখলা সরকার বলেন, উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্নতার সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের বড় অংশই কর্মক্ষেত্রে কাজের চাপে থাকেন। পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে যোগ্যতা অনুয়ায়ী মূল্যায়িত না হওয়া এবং পারস্পরিক খারাপ সম্পর্কও বিষণ্নতার কারণ। তিনি আরও বলেন, নারীরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হন। তাঁদের নিরাপত্তাজনিত উদ্বিগ্নতাও থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স ২০১৪ সালে কর্মক্ষেত্রে মানিসক চাপ বিষয়ে জরিপ করেছিল। ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে জরিপটি চালানো হয়। ‘বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কর্মজীবী নারীদের মানসিক চাপের কারণ ও ফলাফল’ শীর্ষক জরিপে দেখা যায়, ৪৩ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রজনিত মানসিক চাপে ভুগছেন। তাঁরা কম পারিশ্রমিক, চাকরি হারানোর ভয়, বদলির কারণে মানসিক চাপে থাকেন।

ডব্লিউএফএমএইচ বলছে, মানসিক চাপের কারণে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উপস্থিতি ও কর্মদক্ষতা কমে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাপী কর্মীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে নানা নীতি গ্রহণ করা হলেও তাতে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব পায় না। উপযুক্ত কর্মপরিবেশ তৈরিতে কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সেই উদ্যোগে নিয়োগকর্তা, কর্মী, আইনজীবী, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবারকে যুক্ত করতে হবে।

আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট পৃথকভাবে সভা, সেমিনার ও শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *