রাজশাহীতে মুষ্টিচালের মাটির ঘরে ৮৭ বছরের বিদ্যালয়

 

 রাজশাহী | ০৭ অক্টোবর ২০১৭।

মাটির ঘর। মুষ্টিচালের টাকা দিয়ে তৈরি। তাতে কী আছে। কালো রঙে নিকানো সুন্দর এই ঘর ৮৭ বছর পরও এই যুগের ইটের দালানকে লজ্জা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ১৯৩০ সালে এই ঘরেই শুরু হয়েছিল আজকের কালীগ্রাম দোডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়। শুধুই কি তাই? পরীক্ষার ফলাফলে বিদ্যালয়টি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার সেরা বিদ্যালয়। বর্তমানে এর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫৭ জন। তাদের সবাই আসে বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাকে। প্রতিদিনের সমাবেশে শিক্ষার্থীরা যখন এই মাটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে ‘আমার সোনার বাংলা…,’ তখন মনে হয় এ দেশের মাটি সত্যিই সোনার চেয়ে খাঁটি।

মান্দা উপজেলার কালীগ্রামে বিদ্যালয়টির অবস্থান। পাশের গ্রামের সঙ্গে যুক্ত করে বিদ্যালয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল কালীগ্রাম দোডাঙ্গী উচ্চবিদ্যালয়। এখনো বিদ্যালয়টি সেই নামেই পরিচিত। মাটির ঘরের পাশে গড়ে উঠেছে আধুনিক ভবন। কিন্তু সেই মাটির ঘরের কদর কমেনি। ছয় কক্ষবিশিষ্ট এই মাটির ঘরের সামনে ফুলের বাগান করা হয়েছে। এর পাঁচটি ঘরে এখন শিক্ষকেরা বসেন। একটি ঘর দশম শ্রেণির ছাত্রীদের কমনরুম। এই ভবনের পাশেই ১৯৩২ সালে আরও একটি মাটির ভবন তৈরি করা হয়েছিল। সেটির সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি বটগাছ। মাটির এই ভবন ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মেয়েদের কমনরুম।

সম্প্রতি এই বিদ্যালয়ে গিয়ে সমাবেশের দৃশ্য দেখে অভিভূত হতে হলো। শিক্ষকের নির্দেশ পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে সাড়ে ৭০০ ছাত্রছাত্রী সুশৃঙ্খলভাবে সারিতে দাঁড়িয়ে যায়।

টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির ঘরগুলোর প্রসঙ্গ তুলতেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনিছার রহমান শোনালেন এক ঘটনা। কালীগ্রাম গ্রামের জমির উদ্দিন শাহ্ এই বিদ্যালয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর উদ্যোগে বিদ্যালয়ের জন্য পাঁচ একর জমি দান করেন দোডাঙ্গী গ্রামের সমশের পিয়াদা, রুপাই পাইক, কাদির বক্স সরকার, আবদুল জব্বার প্রামাণিক, জেহের উদ্দিন প্রামাণিক, কালীগ্রামের বসির উদ্দিন চৌকিদার এবং মেজাজ উদ্দিন মিঞা।

এ ছাড়া বিভিন্ন মৌজায় ১৬ একর জমি অনুদান হিসেবে পাওয়া যায়। জমি থাকলেও ঘর তৈরি করার মতো নগদ টাকা তখন মানুষের হাতে কম ছিল। জমির উদ্দিন শাহ্র নেতৃত্বে গ্রামে গ্রামে মুষ্টিচাল তোলার জন্য হাঁড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

সপ্তাহান্তে জমির উদ্দিন শাহর আর্দালি কালীগ্রামের হযরত আলী ওরফে হজো হাঁড়িতে জমানো চাল ভাঁড়ে করে নিয়ে আসতেন। এই চাল বাজারে বিক্রি করে সেই টাকা এবং বিভিন্ন গ্রামের মানুষের দেওয়া বাঁশ-কাঠ দিয়ে মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি দিয়ে বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণ করা হলো। বিদ্যালয়ের আঙিনায় পাঁচ একর জমি রয়েছে। প্রথম দিকে এর নাম ছিল কালীগ্রাম-দোডাঙ্গী মাদ্রাসা। এ কাজে জমির উদ্দিন শাহকে সহযোগিতা করেন ভেলু উদ্দিন প্রামাণিক ও কাদির বক্স সরকার। ১৯৫০ সালে অাধুনিক শিক্ষার কথা চিন্তা করে এটিকে জুনিয়র হাইস্কুল করা হয়। ১৯৫৪ সালে বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীত হয়।

বর্তমান সরকারের বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মুহা. ইমাজ উদ্দিন প্রামাণিক এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। পরে তিনি এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন।

কথা হলো দশম শ্রেণির ছাত্র মহসিন আলীর সঙ্গে। সে বলে, ঐতিহ্যবাহী একটি বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে হয়। এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক এখন একজন মন্ত্রী। তিনিও এই মাটির ঘরে ক্লাস করেছেন। ভাবতেই ভালো লাগে।

এই বিদ্যালয়ের ছাত্র সুবাস চন্দ্র দাস বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি ১৯৮৫ সালে বিদ্যালয়টি থেকে এসএসসি পাস করেছি। দুই যুগ পরে গত সেপ্টেম্বর মাসে গিয়েছিলাম। বিদ্যালয় এখন অনেক বড় হয়েছে। পাশে দালান হয়েছে। কিন্তু আমাকে টেনে নিয়ে গেল সেই মাটির ঘর। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমি যে কক্ষগুলোতে ক্লাস করেছি, সেগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ওই মাটির ঘরের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে, যা কোনো দিন ভুলব না।’

এই বিদ্যালয় মানুষ গড়ার সেরা কারিগর। পরীক্ষার ফলাফলেও এটি উপজেলার মধ্যে সেরা। বললেন মান্দার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান।

বিদ্যালয় থেকে বের হয়ে আসার সময় প্রধান শিক্ষক আনিছার রহমান দেখাতে নিয়ে গেলেন বিদ্যালয়ের ‘সততা স্টোর’। মাঠের এক প্রান্তে একটি ঘর তৈরি করা হয়েছে এই দোকানের জন্য। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ সাজিয়ে রাখা হয়েছে। লেখা আছে কোন জিনিসের কত দাম। কিন্তু কোনো বিক্রেতা নেই। আছে একটি ‘ক্যাশ বাক্স’। সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই কেনা জিনিসের টাকা রেখে যাচ্ছে। এ-ও এক দৃষ্টান্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *