বাংলার দর্পন ডটকম :
দৃঢ় নেতৃত্ব এবং স্থিতিশীলতার কথা বলে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে মেয়াদ পূর্তির তিন বছর আগেই যে নির্বাচন ডেকেছিলেন, তাতে ব্রিটেনের ভাগ্যে জুটেছে সবচেয়ে দুর্বল নেতৃত্ব এবং অস্থিরতার ভবিষ্যৎ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদ বা ব্রেক্সিট বিতর্কে মাত্র এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় আরেকজন প্রধানমন্ত্রীরও বিদায় ঘণ্টা বেজে উঠেছে।
সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোয় থেরেসা মের নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবেই নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিপরীতে, আভিজাত্যের রাজনীতিতে প্রায় অচ্ছুৎ এবং নজিরবিহীন প্রতিকূলতার মধ্যে টিকে থাকা রাজনীতিক জেরেমি করবিন লেবার পার্টির ভাগ্য ফিরিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বেই কুড়ি বছর পর দলের পক্ষে জাতীয় পর্যায়ে ভোটের হার ১০ শতাংশ বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছেছে। রাজনীতিবিমুখ তরুণেরা করবিনের শোনানো আশার বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তন ঘটানোর প্রত্যয়ে দলে দলে ভোটকেন্দ্রে গেছেন। যে নির্বাচনে থেরেসা মের নেতৃত্বের শক্তি অর্জনের কথা ছিল, তাতে উল্টো ক্ষমতায়িত হয়েছেন বিরোধী নেতা জেরেমি করবিন। লেবার পার্টিতে তাঁর নেতৃত্ব এখন অনেকটাই সংহত হবে।
সন্দেহ নেই থেরেসা মের কনজারভেটিভ পার্টি বৃহত্তম দল হিসেবে সরকার গঠনের প্রথম সুযোগটি পাবে। কিন্তু, পার্লামেন্টে প্রতিটি বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য থেরেসা মেকে কোনো না কোনো ছোট দলের ওপর নির্ভর করতে হবে। সে ক্ষেত্রে উত্তর আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির (ডিইউপি) ১০ জন সদস্য কনজারভেটিভদের সহযোগী হলেও তাঁদের সমঝোতা কতটা টেকসই হবে, তা বলা মুশকিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে, থেরেসা মের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি আসবে তাঁর দলের ভেতর থেকেই। সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু, ব্রেক্সিট প্রশ্নে বরিসের কট্টরবাদী পরিচিতির কারণে তা খুব একটা সহজ হবে না। অর্থমন্ত্রী ফিলিপ হ্যামন্ড পুরো নির্বাচনী প্রচারে প্রায় অন্তরালেই ছিলেন। সুতরাং, নব উদ্যমে দলের হাল ধরার জন্য তাঁর এগিয়ে আসার সম্ভাবনাও নাকচ করা যায় না। তা ছাড়া বিরোধীদের পক্ষ থেকেও থেরেসা মের পদত্যাগের দাবি ওঠার সম্ভাবনাই এখন প্রবল।
ব্রেক্সিট প্রশ্নে দর-কষাকষির জন্য থেরেসা মে ইউরোপীয় নেতাদের যে কঠোর অবস্থানের আভাস দিচ্ছিলেন, এই নির্বাচনী ফলাফলে তা নাকচ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ব্রিটেনের জন্য সুবিধাজনক না হলে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়াই বিচ্ছেদের প্রস্তাব ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেসব উগ্রজাতীয়তাবাদী রাজনীতিকের কারণে ব্রেক্সিট ধারণার উদ্ভব এবং গণভোট, তাঁদের অন্যতম নাইজেল ফারাজ এরই মধ্যেই বিবিসিকে বলেছেন, এই নির্বাচন আরেকটি গণভোট অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছে। ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টি বা ইউকিপ নির্বাচনে কোনো আসন না পেলেও ব্রেক্সিটকেন্দ্রিক রাজনীতিতে দলটির ভূমিকা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।
আর্থিক বাজারের উদ্বেগ-উৎকণ্টাকেও ভোটাররা তেমন একটা গায়ে মেখেছেন বলে মনে হয় না। আর্থিক বাজার এবং বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা না হলে স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ার যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, তাতেও সাধারণ ভোটাররা কান দেননি। বিশেষত করে বামপন্থী নেতা জেরেমি করবিন এবং ছায়া অর্থমন্ত্রী সমাজতন্ত্রী জন ম্যাকডোনাল্ডকে পুঁজিবাদবিদ্বেষী অভিহিত করে তাঁদের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টির অর্থনৈতিক কর্মসূচি ব্রিটেনের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেবে—এমন হুঁশিয়ারিও কাজে আসেনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ভবিষ্যদ্বাণীকে ভুল প্রমাণ করা এই নির্বাচনে একইভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে প্রথম সারির রক্ষণশীল সংবাদপত্রগুলো। টাইমস, টেলিগ্রাফ, সান এবং ডেইলি মেইলের মতো পত্রিকাগুলো শুধু যে থেরেসা মেকেই সমর্থন দিয়েছে তা-ই নয়; বরং বিরোধী নেতা জেরেমি করবিনকে নিয়ে হয় আতঙ্ক ছড়িয়েছে, নয়তো অরুচিকর ব্যঙ্গবিদ্রূপ করেছে। এসব সংবাদপত্র ছাড়াও মূলধারার গণমাধ্যমের পক্ষপাতকে ভোটাররা প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সামগ্রিকভাবে ব্রিটেন যে এখন একটা অভূতপূর্ব অনিশ্চয়তার যুগে প্রবেশ করল, তাতে সন্দেহ নেই। এই অস্থিরতার প্রভাব যে শুধু ব্রিটেনের সীমানাতেই আটকে থাকবে তা নয়। ইউরোপ এবং বাকি বিশ্বের ওপরও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।