ধ্বংস হচ্ছে হাজারো প্রজাতির মৎস্য পোনা
সোনাগাজী(ফেনী) প্রতিনিধি:
ফেনী নদীর মুহুরী রেগুলেটর সংলগ্ন দুপাড়ে নিষিদ্ধ মশারি ও ঠেলা জাল দিয়ে গলদা ও বাগদা চিংড়ির রেনু আহরণ করছে স্থানীয়রা এতে ধ্বংস হচ্ছে অন্যান্য হাজারো জাতের মৎস্য পোনা। প্রকাশ্য দিবালোকে চললেও দেখার কেউ নেই। একই চিত্র উপজেলা সদর ইউনিয়নের জেলেপাড়া ও চর খোন্দকার এলাকায়। জেলেরা চিংড়ির রেনু আহরণ করে বিক্রি করছেন স্থানীয় ব্যাপারিদের কাছে। তারা সেগুলো দ্বিগুণ দামে বিক্রি করছেন খুলনা, বাগেরহাট ও যশোরসহ দেশের বিভিন্ন চিংড়ি ঘের মালিকদের কাছে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, একটি গলদা বা বাগদা চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ করতে গিয়ে অন্য ৪শ ৬৩ প্রজাতির মাছের রেনু পোনা ধ্বংস হয়। আর সঙ্গে নদীর পানিতে বাস করা ক্ষুদ্র জীবকণা ধরা হয় তাহলে তার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৭শ ৬৩টি। এটা সার্বিকভাবে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদের জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ। এটা কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বাংলাদেশের নদীগুলো ধীরে ধীরে মাছশূন্য হয়ে যাবে। আর নিয়ন্ত্রণ করা গেলে বাংলাদেশের মৎস্য সম্পদ বাড়বে দিনকে দিন।
জানা গেছে, প্রতি বছর এপ্রিল থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ফেনী নদীর মুহুরী রেগুলেটরের দুই পাশ, সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের জেলেপাড়া,চর খোন্দকার, থাক খোয়াজ লামছি, ছোট স্লুইচ গেট, চর খোয়াজের লামছিসহ অংশে চিংড়ির রেনু আহরণ চলে। জেলেরা শুধু বাগদা-গলদা চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করে অন্যান্য মাছের রেনু ও জলজ প্রাণীর পোনা ডাঙ্গায় ফেলে দেয়।
পোনা ক্রেতা মহাজনরা জানান, ফেনী নদীর মুহুরী রেগুলেটর এলাকা থেকে চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার ইছাখালী এবং ছোট ফেনী নদীর মুছাপুর ক্লোজার থেকে দক্ষিণে সন্দ্বীপ চ্যানেল পর্যন্ত বিশাল উপকূলীয় এলাকায় কোটি কোটি চিংড়ি পোনা আহরণ করা হচ্ছে প্রতিদিন। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট এবং সোনাগাজী উপকূলীয় অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষ নদীতে চিংড়ি পোনা আহরণ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছেন।
খুলনা থেকে আসা জেলে শাখাওয়াত হোসেন জানান, চিংড়ির রেনু পোনা আহরণ করার জন্য তিনি দুই মাসের জন্য এ এলাকায় এসেছেন। স্থানীয় মহাজনের মাধ্যমে তিনি নদী থেকে এ পোনা আহরণ করে প্রতি পিস এক টাকা ধরে বিক্রি করেন।
তিনি আরো জানান, তারা নদী থেকে মশারির জাল দিয়ে অন্য পোনাসহ চিংড়ির পোনাগুলো আহরণ করা হয়। চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করার সময় কোরাল, কাঁকড়া, বাইলা, মলা-ঢেলা, টেংরা, পোয়া, লইট্টাসহ অনেক প্রজাতির পোনা আসে। পরে চিংড়িটা রেখে অন্যগুলো ডাঙ্গায় ফেলে দেয়া হয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য আহসান উল্যাহ জানান, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর এলাকার ঘের মালিকরা সোনাগাজী ও মীরসরাই এলাকার আড়তদারদের মাধ্যমে চিংড়ির রেনু সংগ্রহ করেন। আড়তদাররা জেলেদের কাছ থেকে রেনু সংগ্রহ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি পোনা এক টাকায় বিক্রি করলেও খুলনা পর্যন্ত যেতে তার দাম পড়ে তিন টাকার মত।
সাবেক এক ইউপি সদস্য বলেন, এ কাজে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার থেকে শুরু করে প্রশাসন এবং কী মৎস্য অফিসও জড়িত। সবাই নির্দিষ্ট হারে কমিশন পায়। সোনাগাজী থানার সামনে দিয়েই ড্রামে ড্রামে চিংড়ির এসব রেনু যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়েই চলছে এই অবৈধ কারবার। দেখার কেউই নেই।
মীরসরাইয়ের নিজাম উদ্দিন জমিদার, মফিজ উদ্দিন জমিদার, সোনাগাজীর ওবায়দুল হক, আহসান ঊল্যাহ, আলমগীর হোসেন প্রকাশ্যে ছোট ছোট ঘর করে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর থেকে লোক এনে এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। সবার সামনেই ড্রামে করে নিয়ে যাচ্ছে এসব পোনা, নেওয়া হয় না কোনো ধরনের ব্যবস্থা।
সোনাগাজী সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল আরেফিন বলেন, এ অবৈধ কাজের ফলে নদীর কোটি কোটি টাকার মাছ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগীতায় একটি সিন্ডিকেট প্রতি বছর ফেনী নদীর মাছ ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, অবৈধ কাজের জন্য বড় ধরনের কোনো সাজা ও জরিমানার নজির নেই। যা হয় তা লোক দেখানো। অভিযানে আসার আগে মৎস্য অফিসের লোকজনই অবৈধ কারবারিদের ফোন করে দেন। অভিযানে এলে আর নদীতে কাউকে পাওয়া যায় না।
এক সময় এ অঞ্চলে অনেক মাছ পাওয়া যেতো। এভাবে চিংড়ির রেনু আহরণ করতে গিয়ে মাছের অনেক প্রজাতি ধ্বংস হচ্ছে, এর ফলে নদীতে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। নদী থেকে এই রেনু ধরা বন্ধ করার দরকার। এর ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক মৎস্য সম্পদ দিন দিন মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তূর্য সাহা বলেন, প্রজনন মৌসুম থাকায় এ সময়টাতে নদীতে মাছ ধরার প্রতি রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা।আমরা প্রতিবছর অভিযান পরিচালনা করি। এবছর এখনো অভিযান হয়নি তবে শীঘ্রই হবে। উপজেলা প্রশাসন থেকে সহায়তা নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানো হবে এবছরও এবং মৎস্য সংরক্ষণ আইনের আওতায় শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি আরও জানান, এই রেনু আহরণে বেশি ক্ষতি হচ্ছে ইলিশের। এতে হাজারো জলজ প্রাণি ধ্বংস হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য দরকার ব্যাপক গণসচেতনতা ও জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান।