খাসোগির পরে মোহাম্মদ বিন সালমান‘র টার্গেট কি সাদ আল-জাবরি ?

প্রতিবেদক :
সৌদি আরবের অঘোষিত শাসক এখন মোহাম্মদ বিন সালমান। আর এ জায়গাটি পেতে পেছনের দরজা দিয়ে কমকাজ সমাধা করেননি তিনি। কিন্তু তাও তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। ফলে করোনাকালেও তিনি বসে নেই। মসনদে নিজের আসন পাকাপোক্ত করতে এবার তিনি পেছনে লেগেছেন এক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তার। সাদ আল-জাবরি নামের সাবেক ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যকে তিনি আটক করেছেন এরই মধ্যে।

বর্তমানে কানাডায় স্বেচ্ছা নির্বাসিত থাকা সাদ আল-জাবরির মূল অপরাধ তিনি মসনদের অন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দাবিদার মোহাম্মদ বিন নায়েফের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ লোক। আবার সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হওয়ায় তাঁর কাছে রয়েছে বেশ কিছু গোপন নথি। ফলে তাঁকে হাতের মুঠোয় পেলে মসনদে আরোহণের পথে বিন সালমানের আর কোনো বাধা থাকবে না।

সৌদি যুবরাজ বিন সালমান নিজের ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করতে সবকিছুকে তুচ্ছ করতে রাজি। পশ্চিমা শক্তিগুলোকে নিজের দিকে টানতে একদিকে তিনি নানা সংস্কার পরিকল্পনা সামনে আনছেন, অন্যদিকে চিরাচরিত পন্থায় প্রাসাদ রাজনীতি করে চলেছেন। সেখানে কোনো সংস্কারের ধার ধারছেন না তিনি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার কারণে তাঁকে নিয়ে শুরু হওয়া সমালোচনা এখনো থিতিয়ে আসেনি। অথচ সেই একই রাস্তায় পথচলা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। অবশ্য কেনইবা চলবেন না?

খাসোগি হত্যার পর অনেকেই ভেবেছিলেন এবার বিন সালমান কিছুটা সমঝে চলবেন। কিন্তু না, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে শান্ত করতে একটি নামকাওয়াস্তে বিচারকাজ চালালেন, অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্তও হলো। তারপর সেই পুরোনো পন্থা অনুসরণ করে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে খাসোগি-পুত্রকে দিয়ে দোষীদের মাফও পাইয়ে দিলেন। অবশ্য কারা মাফ পেল, তার কোনো খোঁজ পৃথিবী জানল না। কারণ, এ ঘটনায় অভিযুক্তদের নামই কখনো প্রকাশ করা হয়নি। তাই পুরো অভিযোগ গঠন থেকে শুরু করে পুরো বিচার ও তৎপরবর্তী ক্ষমা—সবই থাকল ‘কাজির গরু’ হয়ে। এদিকে খাসোগি হত্যার পরপর আন্তর্জাতিক মহল কিছুদিন বেশ হইচই করলেও শেষ পর্যন্ত কিছুই করল না। ঘটনার জন্য বিন সালমানই দায়ী মর্মে কিছু আনুষ্ঠানিক বিবৃতি ছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো না।

ফলে ভিন্নমত ও বিরোধী পক্ষ দমনে বিন সালমান নিজের রাশ কেন টানবেন? তিনি টানছেনও না। এই করোনাকালেই তাই সাবেক ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন নায়েফকে বন্দী করা হলো, যিনি বিন সালমান ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর থেকেই গৃহবন্দী ছিলেন। গ্রেপ্তার করা হলো বিন সালমানের আরেক ভাই রাজপুত্র আহমেদ বিন আবদুল আজিজকে। আটক করা হলো প্রিন্সেস বাসমাহকে। বিন সালমান যাঁদেরই আটক করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই থাকে দুর্নীতির অভিযোগ। এ ক্ষেত্রেও তা–ই করা হচ্ছে। যদিও অর্থ ও আনুগত্যের বিনিময়ে এসব অভিযোগ থেকে মুক্তিও মেলে, যার প্রমাণ গত কয়েক বছরে একাধিকবার পাওয়া গেছে।

সে যা-ই হোক, বিন সালমান এবার পিছু নিয়েছেন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা সাদ আল-জাবরির। গত কয়েক মাসে সৌদি যুবরাজ সাদ আল-জাবরির পরিবারের ওপর চাপ সৃষ্টির নীতি নিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি চান জাবরি সৌদি আরবে ফিরে আসুন। কানাডায় থাকা জাবরির পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে, এরই মধ্যে জাবরির দুই সন্তানকে আটক করা হয়েছে।

সাদ আল-জাবরি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফের দীর্ঘদিনের উপদেষ্টা ছিলেন। বিন নায়েফকে ২০১৭ সালে প্রাসাদ–অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাতারাতি মসনদের উত্তরাধিকারের পদ থেকে সরিয়ে দেন বিন সালমান। আর এর মধ্য দিয়েই বিন সালমান সৌদি আরবের অঘোষিত শাসক বনে যান। গত মার্চে বিন নায়েফসহ রাজপরিবারের আরও দুই সদস্যকে আটকের কয়েক দিনের মধ্যেই সাদ আল-জাবরির দুই সন্তান ২১ বছর বয়সী ওমর ও ২০ বছর বয়সী সারাহকে আটক করা হয়। এরপর গত মে মাসের শুরুর দিকে আটক করা হয় সাদ আল-জাবরির এক ভাই আবদুলরহমান আল-জাবরিকেও। পরিবারের সদস্যদের আটক করে বিন সালমান মূলত সাদ আল-জাবরিকে দেশে ফিরিয়ে এনে তাঁর কাছে থাকা কিছু নথি হস্তগত করতে চান। এসব নথি তিনি তাঁর বিরোধী পক্ষকে ধরাশায়ী করতে ব্যবহার করবেন। একই সঙ্গে তাঁর মধ্যে এই শঙ্কাও রয়েছে যে জাবরির কাছে তাঁর ও তাঁর বাবার (বর্তমান বাদশাহ) জন্য ক্ষতিকর কিছু তথ্যও রয়েছে।

কী রয়েছে নথিতে? বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাদ আল-জাবরির কাছে থাকা নথির মধ্যে রয়েছে বিদেশে বিন নায়েফের সম্পদের তথ্য, যা বিন সালমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া রাজপরিবারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সদস্যের আর্থিক লেনদেন–সম্পর্কিত গোপনীয় নথিও রয়েছে জাবরির কাছে। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির তালিকায় বর্তমান বাদশাহ সালমান ও বিন সালমান নিজেও রয়েছেন।

এসব নথির মধ্যে রিয়াদের গভর্নর থাকাকালে বর্তমান বাদশাহ সালমানের করা বিভিন্ন ভূমি মালিকানা–সম্পর্কিত চুক্তি ও লেনদেনের তথ্য রয়েছে। সন্দেহ নেই এই তথ্যগুলো আড়াল করতে চান বিন সালমান। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে থাকার সময়ে বিন নায়েফের বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ–সম্পর্কিত তথ্যও তাঁর ভীষণভাবে প্রয়োজন।

আর অনেক কারণেই সাদ আল-জাবরি বিন সালমানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বিন নায়েফের সঙ্গে দুই দশকের বেশি সময় কাজ করেছেন। সৌদি আরবের গোয়েন্দা বিভাগকে নতুন করে গড়ে তোলা, সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা ও পশ্চিমের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের কাজটি সামনে থেকে করেছেন আল-জাবরি। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ) ও সৌদি গোয়েন্দা বিভাগের মধ্যকার সম্পর্ক সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বাদশাহ সালমান মসনদে বসার পর তিনি আল-জাবরিকে মন্ত্রী পর্যায়ে নিয়ে আসেন। একই বছরের এপ্রিলে বিন নায়েফ ক্রাউন প্রিন্স হন। সে সময় সাদ আল-জাবরির সঙ্গে বিন সালমানের সম্পর্কও বেশ ভালো ছিল। পরে আল-জাবরির বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে একই বছরের আগস্টে পদচ্যুত করা হয়। সে সময় থেকেই তিনি বিন নায়েফের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ২০১৭ সালের জুনে বিন নায়েফ ক্রাউন প্রিন্স থেকে পদচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। সে সময়ই তিনি কানাডায় পাড়ি জমান। তাঁর পরিবারের একাংশ সৌদি আরবে থেকে যায়। তাঁদের কানাডায় যেতে দেওয়ার বিনিময়ে বিন সালমান একাধিকবার জাবরিকে রিয়াদে ফেরার চাপ দেন। এবার তাঁদের আটক করে আরও সরাসরি চাপ প্রয়োগের রাস্তা ধরলেন তিনি।

বিন সালমান মূলত নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চান। বাদশাহ সালমানের সমর্থনপুষ্ট হয়ে ক্ষমতার পথে থাকা সব কাঁটা এক এক করে উপড়ে ফেলছেন তিনি। রাজপরিবারের ভেতরে কিংবা বাইরে কোথাও কোনো সমালোচনা সহ্য করা হবে না—এমন বার্তাই তিনি দিতে চান। এই বার্তা এই সময়ে দিতে চাওয়ার কারণ সম্ভবত অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাওয়া সৌদি আরবের প্রভাবশালী পরিবারগুলোয় ক্রমবর্ধমান বিন সালমান বিরোধিতা। মোহাম্মদ বিন নায়েফকে পরবর্তী উত্তরাধিকারের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলা যায় সৌদি বাদশাহ এক দীর্ঘসূত্রী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের জন্ম দিয়েছেন। ২০১৭ সালের জুনে বিন নায়েফকে অপসারণে যে পথ অনুসৃত হয়েছে, তার কারণেই বিন সালমানকে বরাবরই অভ্যুত্থানের ভয়ে ভীত থাকতে হবে, যা তাঁকে দিনের পর দিন আরও বেশি স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠার জ্বালানিটি দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *