আমি গোলাম ফারুক, বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদ নুরুল আবছারের হতভাগা ছোটভাই বলছি।
আমার এলাকা ফেনীর সোনাগাজী। এই অঞ্চলের সর্বপ্রথম মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন আমার বড় ভাই কমান্ডার নুরুল আবছার। তিনি শুধু একাই দেশের মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েননি। বরং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আরো অনেককে মুক্তি সংগ্রামের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বলয়।
৫ই ডিসেম্বর আমার ভাইয়ের নেতৃত্বে শত্রুমুক্ত হয়েছিলো ফেনী ৩ আসনের সোনাগাজী। তিনি এফ, এফ ফোর্স কমান্ডার ছিলেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য মানবীয় দূর্বলতার শিকারে পড়ে লোভের বশবর্তী হয়ে এই এলাকায় বি.এল.এফ এর কিছু সংখ্যক সুযোগ সন্ধানী মুক্তিযোদ্ধা নামধারী ব্যক্তি লুটতরাজের মাধ্যমে রাতারাতি অবৈধ পথে অর্থ উপার্জন শুরু করে। উল্লেখ্যনীয় যে তারা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নামে মাত্র সামান্য সময়ের জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন । এদের অন্যতম একজন স্বীকৃত রাজাকার কমান্ডারের ভাই সৈয়দ নাসির উদ্দিন , অপর একজন ছিলেন মোশারফ হোসেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত এমন কোনো অপকর্ম নেই যেখানে তারা জড়িত নন।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাণিজ্য, ভূয়া অমুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযোদ্ধা বানানো ,কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের আড়াল করা ,রাজাকার বাণিজ্য এবং যুদ্ধাহত না হয়েও যুদ্ধাহত ভাতা গ্রহণ করা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামে বরাদ্দকৃত ভূমি দখল প্রভৃতি অপকর্মে তারা লিপ্ত। যুদ্ধে নিজেদের স্বাপর্থর মনোভাবের জন্য সুনাম অর্জন করতে না পারলেও তারা চুরি-ডাকাতিতে যথেষ্ট দুর্নাম অর্জন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছিলেন যেটা আজও ইতিহাস সাক্ষী ।
দেশের জনগণের শান্তি নিশ্চিত করতে তাদের এইসব অপকর্মে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কারণে কুখ্যাত রাজাকার এবং তার ভাই মিলে আমার ভাইকে খুন করে। শুধু তাই নয়। তারা তার লাশও গুম করে রেখেছিলো। অবশেষে আমার এলাকার সংসদ সদস্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এ বি এম তালেব আলী সাহেব এবং জয়নাল আবদীন হাজারী সাহেব বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদনের পর ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমার ভাইয়ের লাশ হস্তান্তর করা হয় আমার শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে। আমি বঙ্গবন্ধুর কাছে এর জন্য কৃতজ্ঞ ।
দুর্ভাগ্য হলেও চরম সত্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের পরিবারকে নানারকম ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়। তাই সন্তান হারানোর বেদনা বুকে চেপে আমার পরিবার নিরবে শুধু অশ্রু ঝরিয়েছে। বিচারের আবেদন নিরবে কঁদেছে। কিন্তু বিচারের জন্য আদালতে শরণাপন্ন হওয়ার সাহস করেননি।
বহমান সময় গড়িয়েছে বহুদূর। আমার সন্তানহারা বাবা মা বুকে পাথর চেপে বিচারের আশায় প্রহর গুনেছেন। জাগতিক দুনিয়ায় বিচার না পেয়ে আমার বাবা-মা আজ দুজনই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। আবহেলিতই থেকে গেছে এক আত্নোৎসর্গকারী শহীদের বিচারের দাবী।
মৃত্যুর আগে আমার সন্তানহারা মা দুঃখ করে বলেছিলেন, যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমাদের স্নেহ মায়া-মমতা ভুলে আমার ছেলে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা এসে আজ দেশের হাল ধরেছেন। আজও কি, আমার ছেলের খুনীদের বিচার হবে না?
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা আমাদের প্রাণপ্রিয় জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায়, তখন নতুন করে আশায় বুক বেঁধে বিচারের আর্জি জানিয়েছি তাই ।
আমাদেরই ইতিহাস রক্ষক মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে উনার নির্দেশে বিচারের জন্য আবেদন করা হয়েছে ইতিমধ্যে। এ দাবি শুধু আমার পরিবারের একার নয়, এই দাবীটি হল ফেনীর দক্ষিণ অঞ্চলের প্রত্যেক জনতার।
বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে যে যুবক প্রিয়জনের মায়ার বন্ধন ছেড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জীবন বাজি রেখেছিলেন। তিনি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেবার আগেই ঘাতকের নির্মম ষড়যন্ত্র কেড়ে নিয়েছিলো তার মূল্যবান জীবন। সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা এই সর্বোচ্চ ত্যাগের পথে চলতে গিয়ে তার মনের গহীনে না তার কিছু প্রত্যাশা ছিলো আর না ছিলো প্রাপ্তির মোহ।
কিন্তু আমাদের আগামী প্রজন্মকে সেই সব বীর সন্তানের ত্যাগের পথে উজ্জীবিত করতে আমার পরিবার এবং এলাকাবাসী মনে করে আজ সময় এসেছে নায্য বিচার পাবার।
আমার এবং এলাকাবাসীর পক্ষ হতে বিনীত আবেদন আমাদের ইতিহাস রক্ষকদের কাছে, কোন পদ, পদক কিংবা অর্থনৈতিক কোন মূল্যায়ন নয়। শুধু শহীদের সমাধি পাশে বয়ে যাওয়া সোনাগাজী মেইন সড়কটির নাম ”শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল আবছার সড়ক” রাখা হোক।
দীর্ঘ দিন ধরে শহীদের কবরে লুটিয়ে থাকা অভিমানী পথের ধূলো যে পথে বয়ে যেতে যেতে নিরবে বলে যাবে”- এক নদী রক্ত পেরিয়ে বাংলার আকাশে রক্তিম সূর্য আনলে যারা তোমাদের এই খণ কোনদিন শোধ হবে না।
লেখক :
গোলাম ফারুক
বীর মু্ক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শহীদ নুরুল আবছার এর ছোট ভাই।