বাঙালির শোকের মাস আগস্ট শুরু | বাংলারদর্পন

নিউজ ডেস্কঃ

দিন আসে, মাস যায়, একটা করে বছর যেতে থাকে। যা কিছু পিছনে ফেলে যাই, সেই অতীত মনে গেঁথে থাকে। কিছু মধুর অতীত মনে থাকে মধুর হয়েই। আর যে অতীত যন্ত্রণা দিয়ে যায়, তা মনের মধ্যে বিভীষিকা হয়েই বেঁচে থাকে আজীবন। কিছু কিছু বিশেষ দিন, মাস বা বছর আমাদের কাছে বেশি স্মৃতিময় বা বেদনাময় হয়ে থাকে। বাঙালি জাতিকে যদি সবচেয়ে বেদনার মাস, সবচেয়ে বেদনার সময়টা বলতে বলা হয়, আমরা হয়ত নিঃসন্দেহে আগস্টের নাম বলবো। আর শোকের মাস বলতে তো আগস্টকেই আমরা চিনি।

আগস্ট কেন শোকের সেটা নিশ্চয়ই নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হয় না। আগস্ট মানেই অনেককিছু হারানো, আমাদের ইতিহাসে অনেক বিয়োগাত্মক ঘটনার সাক্ষী এই আগস্ট। আমরা এই মাসেই হারিয়েছি আমাদের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুধু তাই নয়, তার পরিবারের প্রতিটি অমূল্য সদস্যকেও আমরা হারিয়েছি।

আমাদের দেশ হারিয়েছে তার একমাত্র কাছের নির্ভরযোগ্য অভিভাবককে। দেশকে মেরুদণ্ডহীন করে ফেলতে আমাদের দেশের আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা শত্রুরাই জাতির পিতা আর তার স্বপ্নকে একেবারে গুড়িয়ে দিতে তাকে সপরিবারে খুন করে। সারাবিশ্ব এতে ধিক্কার জানায়। আমরা জানি, এই শোক বাঙালির কোনোদিনই কাটবে না। যতদিন বেঁচে থাকবো, এই গভীর শোক বয়ে বেড়াতে হবে আমাদের। আগষ্টের শুরুর দিনটি থেকেই চোখের সামনে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছবি ভেসে উঠতে থাকে।

ছোট শিশু রাসেল, মমতাময়ী মা ফজিলাতুন্নেসা মুজিবসহ ঐদিন নিহত সবার নিস্পাপ মুখগুলো জাতি কোনোদিন ভুলবে না। বাঙালি কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায় এই ৭৫ এর ১৫ আগস্টের ঘটনায়। বেঁচে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। যারা এখনো পরিবার হারানোর বেদনা বুকে চেপে দিন কাটাচ্ছেন। এই বর্বরোচিত ইতিহাস আমাদের আজীবন মাথা নিচু করিয়ে দেবে।

শুধু ৭৫ এর ১৫ আগস্টই আমাদের শোকে বিহ্বল করে দেয়না। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের কথা মনে হলে আরেকবার শিউরে উঠতে হয় আমাদের। ঐদিন ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক জনসভায় গ্রেনেড হামলা চলে। ২০০৪ সালের সারাদেশে জঙ্গিদের বোমা হামলা এবং গোপালগঞ্জে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ২১ আগষ্ট বিকেলে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা।

মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরিত হয় ১১টি শক্তিশালী গ্রেনেড। এতে ঘটনাস্থলেই ১২ জন এবং পরে হাসপাতালে আরও ১২ জন নিহত হন। এর মাঝে ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জিল্লুর রহমানের স্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান। তিনি মারাত্মক আহত হয়ে এই আগস্টের ২৪ তারিখেই মারা যান। এখনো আহত পঙ্গু অবস্থায় আছেন অসংখ্য মানুষ। এই দগদগে ক্ষত বাঙালি কি কোনোদিন ভুলবে?

এখানেই থেমে থাকেনি আগস্টের বিধ্বংসী রূপ। এরপরের বছরেই ঘটে ৬৩ জেলায় একসঙ্গে সিরিজ বোমা হামলা। দিনটি ১৭ আগস্ট, ২০০৫। পুরো দেশ যেন কেঁপে ওঠে বোমার আঘাতে। এইদিন সকাল সাড়ে বেলা ১১টা থেকে মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে দেশের ৬৩ জেলার প্রেসক্লাব, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টিসহ সাড়ে ৪শ’ স্পটে প্রায় ৫শ’ বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। এই হামলায় নিহত হন ২ জন এবং আহত হয় দু’শতাধিক মানুষ। এই বিভীষিকার কথাই বা আমরা কীভাবে ভুলবো?

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের কাছে আজীবন স্মরণীয়। এই মুক্তিযুদ্ধেরও ভয়াবহ কিছু ইতিহাস আজও শুনলে চমকে উঠি আমরা। এই যেমন, ৭১ এর খুলনা জেলাধীন দিঘলিয়ার দেয়াড়া গ্রামে রাজাকার বাহিনী ও পাকিস্তানি সেনারা গুলি করে ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে খুঁচিয়ে ৬০ জন নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করে। সেদিনের কথা স্মরণ করে আজও শিউরে ওঠে সেই অঞ্চলের মানুষ। সেটাও এই আগস্ট মাসেই, তারিখটা ছিল ২৭ আগস্ট, ১৯৭১।

এ তো গেলো আমাদের দেশীয় ইতিহাসের ঘটনা দুর্ঘটনা। দেশের কিছু সূর্যসন্তানকেও জাতি হারিয়েছে এই আগস্টেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যার সৃষ্টি আমাদের সারাজীবনের প্রেরণা, ভালোবাসা আর পরিচয়ের বাহক। তিনি পরপারে পাড়ি জমান ২২ শে শ্রাবণ, আমাদের ক্যালেন্ডারের ৭ আগস্ট। জাতীয় বিদ্রোহ জাগানিয়া প্রেম-বিরহের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে হারিয়েছি ১২ ভাদ্র অর্থাৎ ২৯ আগস্ট।

সর্বশেষ সমসাময়িক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান, যিনি বহুদিন দাপটের সঙ্গেই সাহিত্যচর্চা করেছেন। এই প্রতিভাধর মানুষটিকেও আমরা হারিয়েছি আগস্টে, ১৭ আগস্ট ২০০৬ তে।

অনেকগুলো বিভীষিকা, অনেকগুলো দুর্ঘটনা, অনেক বিখ্যাত মানুষকে হারানো এই আগস্টের শুরু হলো। আগস্ট নামটা শুনলেই আজও অজানা আতঙ্কে বাঙালির বুক কেঁপে ওঠে। পুরো মাসটাই হৃদয়বিদারক ঘটনাকে সাক্ষী করে ইতিহাসে টিকে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *