জনবল সংকটে সাতক্ষীরার স্বাস্থ্য সেবা: ২০০ রোগীর বিপরীতে ৪ জন ডাক্তার

শেখ আমিনুর হোসেন, সাতক্ষীরা ব্যুরো চীফ:

সাতক্ষীরার ১০০ শয্যার সদর হাসপাতালে দৈনিক গড়ে ২০০ রোগী ভর্তি থাকে। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিনে আউটডারে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসে আরো ৬০০ থেকে ৮০০ জন রোগী। এমন একটি হাসপাতালে ডাক্তারের সংখ্যা মাত্র ৪ জন।

স্বাস্থ্য সেবায় এমন বর্ননা তুলে ধরে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বর্তমান চিকিৎসক সংকট, দুর্নীতি এবং অবহেলার কারণে চিকিৎসা খাতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি  হয়েছে। তারা জানান, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আধুনিক চিকিৎসার সরঞ্জাম রয়েছে প্রচুর। কিন্তু জনবল সংকটের কারনে রোগীরা যথার্থ সেবা পাচ্ছেন না। এমন অবস্থায় একজন সরকারী ডাক্তার তার নৈমিত্তিক দায়িত্ব ফেলে রেখে বেসরকারি ক্লিনিক অথবা প্রাইভট প্র্যাকটিস সময় দিলে স্বাস্থ্য সেবা মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আর এসব কারনে ভুক্তভোগী রোগীরা চিকিৎসা না পেয়ে গালিগালাজ করেন। এমনকি চিকিৎসকের ওপর হামলা চালান বলেও উল্লেখ করেন তারা।

শনিবার সন্ধ্যায় সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে বিএমএ ভবনে সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা তুলে ধরেন আয়োজকরা। এতে সভাপতিত্ব করেন স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোখলছুর রহমান।

মত বিনিময় সভায় তারা বলেন, এমবিবিএস পাস করার পর বিসিএসর অপেক্ষায় ৪ বছর শেষ করেছেন একাক জন ডাক্তার। এ ব্যাপারে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দীর্ঘসূত্রিতার উল্লেখ করে চিকিৎসকরা বলেন, এডহক ভিত্তিতে চিকিৎসক নিয়োগ ও পদায়ন না করা হলে স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন করার কঠিন হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল এক্সরে ফিল্ম থাকে না, ওষুধের সরবরাহও  কম।  একই সাথে একজন ডাক্তার যেমন জরুরী বিভাগের সেবা দিচ্ছেন তেমনি গভীর রাতে জরুরি কলেও সেবা দিচ্ছেন তিনি। এভাবে চিকিৎসা সেবা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। দুইজন কনসালট্যান্ট থাকলে সেবা বিঘ্নিত হত না বলেও জানানো হয় মতবিনিময়। চিকিৎসকরা বলেন, একজন ডাক্তার নাইট ডিউটি ছেড়ে ভোর ৬ টায় ফিরে আবারও সকাল ৮ টায়  কাজে যোগদান করলে তার কাছ থেকে কতটা সেবা পাওয়া যাবে তা অনুমান করা সহজ। সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ এনাটমি ও ফিজিওলেজিতে কোন শিক্ষক নেই। সেখানে এনাটমি পড়ান একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ।

 

বেসিক সায়ন্স শিক্ষার সুযোগ কম আছে উল্লেখ করে তারা বলেন সেখানে মিড লেভেলের ডাক্তার কম। সাতক্ষীরা সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রয়োজন ৫৭ জন ডাক্তারের বিপরীতে রয়েছেন মাত্র ১৬ জন। একজন রোগীর  জন্য ৩ শিফট ৩ জন ডাক্তার দরকার হয়।  একই সাথে দরকার ৯ জন সেবিকাও। অথচ সেই জনবল এখানে নেই। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে কেবলমাত্র এই জেলারই নয়, পাশ্ববর্তী খুলনা ও যশোর জেলা থেকেও অনেক রোগী এসে থাকে বলে জানান তারা। চিকিৎসকরা বলেন, ১০০ শয্যার এই হাসপাতালে জনবল বরাদ্দ আছে ৫০ শতাংশ। অথচ বাস্তব রয়েছে তারও ৫০ শতাংশ জনবল। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ ও একই সমস্যা বিরাজ করছে। জেলায় ৭০ থেকে ৭৫টি বেসরকারি ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেখানে চলছে চিকিৎসার নামে ব্যবসা। তারা কিভাবে সিভিল সার্জনের অনুমোদন পায় এ প্রশ্ন রেখে তারা বলেন, এখন থেকে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত সরকারি কর্মসময় কোন সরকারি ডাক্তার বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখলে তার বিরুদ্ধে এবং একই সঙ্গে ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই সময়ের মধ্যে কোন সরকারি ডাক্তারকে বেসরকারি ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে নিষেধ করেন তারা। 

কলারোয়া,তালা,দেবহাটা সহ প্রায় সব উপজেলায় স্বল্প সংখ্যক ডাক্তার নিয়ে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া দুরও হয়ে পড়েছে বলে মতবিনিময় সভায় উল্লেখ করা হয়। তারা আরও বলেন, প্রতি বছর গড়ে ২ হাজার ডাক্তার অবসরে যাচ্ছেন। অথচ সেই শূন্যস্থান পূরন যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। যে কারনে চিকিৎসক সংকট স্বাস্থ্য সেবা ব্যহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি ১০ জন ভর্তি রোগীর পেছনে একজন ডাক্তার থাকতে হবে। সেই হিসাবে সাতক্ষীরায় ভর্তি হওয়া ২০০ রোগীর জন্য প্রতি শিফটে ২০ জন হলে দৈনিক দরকার ৬০ জন ডাক্তার। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা কমছে, বাড়ছে না জানিয়ে মত বিনিময় সভায় বলা হয়, পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে আরও বেশী গতিশীল করতে হবে।

তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে তারা বলেন, সদর হাসপাতালে প্রয়োজন ২৭ জনেরস্হলে আছে ৪ জন, কালিগঞ্জে ২১ জনের বিপরীতে ৪ জন, আশাশুনিতে ২১ জনের বিপরীতে ৪ জন , কলারোয়া ৩৪ জনের স্হলে ৪ জন, তালায় ৩৩ জনের বিপরীতে ৭ জন, দেবহাটায় ১৬ জনের বিপরীতে ৫ জন এবং শ্যামনগর হাসপাতালে ৩৩ জনের স্হলে ৫ জন ডাক্তার রয়েছেন। এসব হাসপাতালে প্রয়োজন ২০২ জনের স্হলে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ৫১ জন।

মতবিনিময় সভায় বক্তব্যে রাখেন, স্বাচিপ সভাপতি ডা. মোখলছুর রহমান, বিএমএ সভাপতি ডা. আজিজুর রহমান, স্বাচিপ সাধারন সম্পাদক ডা. মনোয়ার হোসেন এবং বিএমএ সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শামসুর রহমান। এতে আরও বক্তব্যে রাখেন সিভিল সার্জন ডা. রফিকুল ইসলাম, সাতক্ষীরা মেডিকল কলেজ হাসপাতালের সুপারেন্টেন ডা. শাজাহান আলী এবং জেলা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক মালিক সমিতির সভাপতি ডা. হাবিবুর রহমান।

বিএমএ ও স্বাচিপ নেতৃবৃন্দ বলেন, জেলায় শতভাগ সরকারি ডাক্তারের মধ্যে আছে মাত্র ২৬ শতাংশ। মাত্র ৫১ জন সরকারি ডাক্তার দিয়ে জেলার  স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন করা কঠিন উল্লেখ করে তারা বলেন, এজন্য দরকার জনবল বৃদ্ধি করা। দেশে রোগ এবং রোগী দুইই বৃদ্ধি পাচ্ছে জানিয়ে তারা বলেন এখন দেশের ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রোগীরা সেবা পাচ্ছে।

 

ডাক্তার আফম রুহুল হক স্বাস্থ্য মন্ত্রী থাকাকালে পাঁচ হাজার ডাক্তারকে নির্বাহী আদেশে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এমনটি না করা হলে স্বাস্থ্য সেবায় নৈরাজ্যকর অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্যে রাখেন সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ, সাবেক সভাপতি সুভাষ চৌধুরী, সাবেক সাধারন সম্পাদক এম কামরুজ্জামান প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *