ট্রাম্প’র সমর্থনে ঝুঁকিপূর্ণ এক খেলায় মেতেছেন সৌদি যুবরাজ

বাংলারদর্পন : যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের সূত্র ধরে সৌদি আরবের ক্ষমতাকেন্দ্র নড়ে উঠেছে, যা অস্থির মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থির করে তুলছে। কিন্তু এসবের দিকে নজর নেই সৌদি যুবরাজের। তিনি বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করছেন। নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ এক খেলায় মেতেছেন সৌদি যুবরাজ। অথচ এসব কর্মকাণ্ডের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জানাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যাঁর নিজের গ্রহণযোগ্যতাই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রমাগত কমছে।

সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সব দিক থেকেই ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করার মিশনে নেমেছেন। রক্ষণশীল ধর্মনেতাদের পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক পরিবর্তনকামীদেরও জেলে পুরছেন। দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতাধর যুবরাজদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছেন, যাঁর মধ্যে রয়েছেন ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান থেকে শুরু করে ধনকুবের পর্যন্ত। কিন্তু যে দুর্নীতির অভিযোগে এই ক্ষমতাধরদের অন্তরীণ করা হয়েছে, তা পুরো সৌদি ক্ষমতাবলয়ের ক্ষেত্রেই খাটে।

এক প্রভাবশালী আরব ব্যবসায়ীর বরাত দিয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত নিজের প্রতিবেদনে ফরিদ জাকারিয়া লিখেছেন, ‘সৌদি আরবে দুর্নীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যার সঙ্গে প্রত্যেক যুবরাজের সম্পর্ক রয়েছে।’ অর্থাৎ সৌদি আরবের ক্ষমতা কাঠামো ও এর মধ্যে প্রোথিত দুর্নীতির বাস্তবতায় ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হওয়া’র কথা। কিন্তু তা যে হচ্ছে না, সেটা তো দৃশ্যমান। কারণ, এখন পর্যন্ত যুবরাজের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন এমন ব্যক্তিরাই শুধু অন্তরীণ হয়েছেন।

প্রশ্ন আসতে পারে সন্ত্রাসবাদের। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগের ছদ্মাবরণে সন্ত্রাসবাদে মদদদাতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বললে তা-ও ধোপে টিকবে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে মোহাম্মদ বিন নায়েফের পতনের কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। গত জুনে মোহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়েই ক্রাউন প্রিন্স করা হয় মোহাম্মদ বিন সালমানকে। কিন্তু গত এক দশক ধরে আল-কায়েদাসহ সব সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মার্কিন নেতৃত্বাধীন লড়াইয়ে প্রশ্নহীন সহযোগিতা দিয়েছেন মোহাম্মদ বিন নায়েফ। কিন্তু দীর্ঘদিনের এ মিত্রের সমর্থনে কোনো বাক্যব্যয় না করে ট্রাম্প তাঁর টুইটার পোস্টে কথা বলেছেন, কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই বর্তমান যুবরাজ পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সৌদি যুবরাজের প্রতি ট্রাম্পের এ সমর্থনকে সাধারণ সংজ্ঞায় ফেলা যায় না কোনোমতেই।

এবার ফিরে তাকানো যাক ডোনাল্ড ট্রাম্পের এশিয়া সফরের দিকে। অনেকটা অনুমিতভাবেই নিজের ১২ দিনের এশিয়া সফরকে ‘ভীষণভাবে সফল’ বলে দাবি করেছেন তিনি। যদিও সাম্প্রতিক এক জরিপ ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। ট্রাম্পের সফরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া দুই দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে ট্রাম্পের প্রতি আস্থা রয়েছে যথাক্রমে ২৪ ও ১৭ শতাংশ মানুষের। বারাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে এ আস্থার হার ছিল যথাক্রমে ৭৮ ও ৮৮ শতাংশ। এ দুই দেশের মানুষের কাছে ট্রাম্প প্রশাসনের গৃহীত ‘আমেরিকাকেই অগ্রাধিকার’ এর বদলে শি চিন পিংয়ের ‘মুক্ত’ দৃষ্টিভঙ্গিটাই বেশি আবেদনময় মনে হচ্ছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ট্রাম্পের আমেরিকা একধরনের আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে। এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যকে পাখির চোখ করে নীতি পরিকল্পনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন, যার কেন্দ্রে রয়েছে ইরান ও ইসরায়েল।

১৬ নভেম্বর ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে ফরিদ জাকারিয়া আরও লিখেছেন, ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি অস্থির মধ্যপ্রাচ্যকে আরও অস্থির করে তুলতে পারে। সৌদি আরবের সাম্প্রতিক অভাবিত ঘটনাগুলোর প্রতি ট্রাম্প সবুজসংকেত পাঠিয়েছেন, যাকে দেশটির ক্ষমতাবলয়ের বিপ্লব হিসেবে অভিহিত করা যায়। এসব পদক্ষেপের কিছু অংশকে সত্যিকার ও বহুল প্রত্যাশিত পুনর্গঠন হিসেবে উল্লেখ করা গেলেও এর প্রতিটিই যেকোনো সময় মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে দিতে পারে।

ঐতিহাসিকভাবেই সৌদি আরবের স্থিতিশীলতা তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর একটি হচ্ছে রাজপরিবার, যার সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ৩০ হাজার। এই রাজপরিবার আবার দ্বিতীয় স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত ক্ষমতাধর গোত্রগুলোর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে যুক্ত। আর তৃতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হিসেবে রয়েছেন অতি-রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতারা, যাঁরা গত চার দশক ধরে নিজেদের অবস্থান ক্ষমতার বলয়ে সংহত করেছেন। এ তিন স্তম্ভই বাদশাহ আবদুল্লাহর সর্বব্যাপী পুনর্গঠন ও বর্তমান রাজবংশের পত্তনের সময় থেকেই রিয়াদের ক্ষমতাকাঠামোর মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ধর্ম ও সমাজের আধুনিকায়নের কথা বলে সালমান এই তিন স্তম্ভের ওপরই একসঙ্গে চড়াও হয়েছেন। এসবই তিনি করছেন তেলভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বহুমুখী অর্থনীতির দেশ হিসেবে সৌদি আরবকে রূপান্তরের এক উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অজুহাতে। আর এ ক্ষেত্রে শুরুতেই তিনি ভেঙে দিয়েছেন সৌদি আরবে প্রচলিত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়াটি। দেশটিতে প্রচলিত ঐকমত্যের ব্যবস্থাকে তিনি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা প্রতিস্থাপন করছেন।

এসব পদক্ষেপ সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন কতটা করতে পারে তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এটি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এরই মধ্যে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। সৌদি যুবরাজের সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো পুরো মধ্যপ্রাচ্যে গোত্র ও সাম্প্রদায়িক সংকটকে আবার উসকে দিতে পারে। কারণ, মোহাম্মদ বিন সালমানের বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে।

ইয়েমেনে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে সৌদি আরব। আর কাতারকে একঘরে করতে আরোপিত অবরোধে কোনো পরিবর্তন এখনো হয়নি। লেবাননের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন তিনি। এই প্রতিটি পদক্ষেপই মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের নেতা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি পদক্ষেপ, যার সঙ্গে রয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতা সংহত করার সমীকরণও। সব মিলিয়ে সৌদি আরবকে কেন্দ্র করে এক ঝুঁকিপূর্ণ ভূরাজনৈতিক খেলার মুখোমুখি বিশ্ব।

লেবাননের সরকারের ওপর হিজবুল্লাহর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী সাদ হারির পদত্যাগ দুটি সম্ভাব্যতার ইঙ্গিত করে। এক. তিনি রিয়াদের চাহিদামতো হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে রাজি হননি। আর দুই এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতাই তাঁর নেই। এটা স্পষ্ট যে লেবাননে হিজবুল্লাহর ক্ষমতা খর্ব করতে চায় সৌদি আরব।

গত কয়েক বছরে সৌদি আরবের মধ্যপ্রাচ্যনীতির কোনোটিই ঠিকমতো কাজ করেনি। ইয়েমেনের যুদ্ধ বিপর্যয়ে রূপ নিয়েছে। কাতারের অবরোধ এখন পর্যন্ত কোনো কাজেই আসেনি। এখন পর্যন্ত লেবাননের শিয়া নেতারা দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান উসকানির মুখে তা কতটা ঠিকে থাকবে তাই এখন প্রশ্নের বিষয়।

কোনো সন্দেহ নেই যে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন ভূরাজনৈতিক খেলায় মেতেছে শক্তিগুলো। যেকোনো মুহূর্তে এটি বড় ধরনের বিপর্যয় ঘনিয়ে আনতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে তিন খেলোয়াড় মোহাম্মদ বিন সালমান, ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কেউই অনুমানযোগ্য নন। আবার তিনজনের অবস্থানই বিপৎসীমায়। মোহাম্মদ বিন সালমান এরই মধ্যে নিজের একগুঁয়ে মানসিকতার যথেষ্ট স্বাক্ষর রেখেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প রুশ-সংশ্লিষ্টতাসহ নানামুখী সমালোচনায় ঘরে ও বাইরে পর্যদুস্ত। আর দুর্নীতির দায়ে ইসরায়েলে নেতানিয়াহুর অবস্থানও টলমল। আধুনিক সময়ের লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির সবচেয়ে বড় এ তিন উদাহরণ নিজেদের পিঠ বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সংক্রমণশীল অস্থিরতায় উপশম খোঁজেন কি না, তাই এখন দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *