বাংলার দর্পন, খেলা ডেস্ক | ৩০ অক্টোবর ২০১৭।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যেন বোলারকে ‘বলি’ দেওয়ার খেলা। ব্যাটসম্যানরা শেষ ৫ ওভারকে বেছে নেন বোলারকে ‘কচুকাটা’ করার জন্য। আগেও যে বোলাররা হেনস্তা হন না, তা নয়, কিন্তু শেষ ৫ ওভারটা বোলারদের জন্য বেশি ভয়ংকর!
ফিল্ডিং দলের অধিনায়কের রাজ্যের দুশ্চিন্তা থাকে এই সময়টাকে নিয়ে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ১৭ ও ১৯তম ওভার দুটিতে অধিনায়কেরা সাধারণত দিনের দলের সেরা বোলারকেই ব্যবহার করতে চান। দলের সেরা ডেথ ওভার বোলারকে দিয়ে ১৭ ও ১৯তম ওভার করিয়ে রান তোলার গতি কমিয়ে দেওয়াটা এখন টি-টোয়েন্টির রীতি। এই কৌশলের সফল ব্যবহার গত আইপিএলে দেখিয়েছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের অধিনায়ক এ দুটি ওভার করাতেন মোস্তাফিজুর রহমানকে দিয়ে। সর্বশেষ বিগ ব্যাশ লিগ চ্যাম্পিয়ন পার্থ স্করচার্সের হয়ে এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন মিচেল জনসন, ভারতের হয়ে এই দায়িত্ব পালন করেন জসপ্রীত বুমরাহ। পচেফস্ট্রুমে গতকাল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে বাংলাদেশের মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ‘সেরা বোলার’ হয়তো ছিলেন না, কিন্তু তিনি খুব খারাপ করছিলেন না। উইকেট পেয়েছিলেন দুটি। সাকিব আল হাসান ৪ ওভারে ২২ রানে দিয়ে প্রোটিয়াদের আটকে রাখার কাজটি করে যাওয়ার পর অবশিষ্টদের মধ্যে সাইফই ছিলেন সেরা।
প্রথম দুই ওভারে ৮ রান দিয়ে নিয়েছিলেন ডি ভিলিয়ার্সের উইকেট। ১৭তম ওভারে বল হাতে নিয়ে প্রথম দুটি বল ডট, তৃতীয় বলে ফেরালেন ৮৫ রান করা হাশিম আমলাকে। পরের তিন বলে দিলেন ছয় রান। ডেথ ওভারে ৬ রান ও ১ উইকেট। ধারাভাষ্যকার থেকে সমর্থক পর্যন্ত সবার মুখেই তখন এই তরুণ পেসারের প্রশংসা।
১৯তম ওভারের আগে ম্যাচে তাঁর বোলিং পরিসংখ্যানটা দেখার মতো, ৩ ওভার ২২ রান ২ উইকেট। উইকেট দুটো ডি ভিলিয়ার্স ও আমলার, স্বপ্নের মতো বোলিংই করেছিলেন সাইফউদ্দিন। কিন্তু এরপর ডেভিড মিলার রীতিমতো ‘গণহত্যা’ চালালেন। পেশিশক্তি কিংবা টেকনিক নয়, সাইফউদ্দিনকে মিলার টেক্কা দিয়েছেন স্রেফ অভিজ্ঞতায়। ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখা যাক।
পুরো ওভারে একটি মাত্র শর্ট বল করেছেন সাইফউদ্দিন, সেটিকে টেনে মিড উইকেটের ওপর দিয়ে ছয় মেরেছেন মিলার। ডেথ ওভারে সাফল্যের সূত্র মেনে বাকি পাঁচটি বলই ফুল লেংথ ডেলিভারি। এর মাঝে প্রথম বলটা ছিল স্লোয়ার। কিন্তু ওভারের প্রথম বলে স্লোয়ার করে ছক্কা খাওয়ার পর দ্বিতীয়বার এই বল করতে সাহস পাননি। অভিজ্ঞতার কাছে মার খেয়ে এই ভুল করা ছাড়া বাকি ছক্কাগুলোয় সাইফউদ্দিনের দোষ খোঁজা যুক্তিযুক্ত হবে না। মিলার লেগ স্টাম্প ছেড়ে দাঁড়ালে বুদ্ধি খাটিয়ে অফ স্টাম্পের বাইরে বল করেছেন। অফসাইডে সরে আসলে বল করেছেন লেগ স্টাম্পে। এর প্রতিটিই ছিল মাথা খাটানো ব্যাপার।
তবে সময়টাই ছিল ডেভিড মিলারের। তাই এক এক করে টানা পাঁচটা ছয় মেরেছেন। ওভারে ৩১ রান দিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির ইতিহাসে সবচেয়ে খরুচে ওভারের তালিকার তিন নম্বরটা বাংলাদেশের এই তরুণ বোলারের। ম্যাচে বোলিং পরিসংখ্যান ৪ ওভারে ৫৩ রান দিয়ে ২ উইকেট।
যাঁরা কালকের ম্যাচে বাংলাদেশের বিপর্যয়ের জন্য এককভাবে সাইফউদ্দিনকে দায়ী করছেন, তাঁরা কয়েকটি পরিসংখ্যান দেখে নিতে পারেন। টি-টোয়েন্টি সবচেয়ে খরুচে ওভার করেছিলেন ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড। যুবরাজ সিংয়ের হাতে ছয়টি ছক্কা খাওয়ার সময় তাঁর বয়স ছিল ২১ বছর। সেদিন ব্রডের সেই ব্যর্থতার পর ইংল্যান্ড যদি ব্রডকে ছুড়ে ফেলত, তবে টেস্ট ইতিহাসের অন্যতম সেরা বোলিং জুটির (অ্যান্ডারসন-ব্রড) জন্ম হতো না। তিন সংস্করণে যথাক্রমে ৩৮৮, ১৭৮ ও ৬৫টি উইকেট পাওয়া বোলার হারিয়ে যেতেন যুবরাজ সিংয়ের অতিমানবীয় ব্যাটিংয়ের কারণে। ডানহাতি বোলিং আর বাঁহাতি ব্যাটিং ছাড়া আরও একটি মিল রয়েছে সাইফউদ্দিন ও ব্রডের মধ্যে। দুজনই ওভারে কোনো অতিরিক্ত রান দেননি। অমন বেধড়ক পিটুনি খেয়ে ঝানু বোলাররাও তাল হারিয়ে ওয়াইড বা নো বল করে বসেন।
দুঃস্বপ্নের সিরিজে কিন্তু একটু আশার ঝলক দেখানো ক্রিকেটার সাইফউদ্দিন। দোষ চাপানোর আগে লড়াকু এই বোলারকে একবার অন্তত পিঠ চাপড়ে দেওয়া হোক। এই সাইফই যে একদিন বাংলাদেশের স্টুয়ার্ট ব্রড হবেন না, তা কে বলতে পারে?