বাংলার দর্পন, সম্পাদকীয়>>>>>
ছেলেবেলায় ঈদুল আজহা মানে কুরবানির ঈদ আসতো একই সঙ্গে আনন্দ আর শঙ্কা নিয়ে। আল্লাহ হযরত ইবরাহিম (আঃ)কে বলেছিলেন তার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কুরবানি করতে। হযরত ইবরাহিম ভেবে দেখলেন, তার সবচেয়ে প্রিয় আসলে সন্তান ইসমাইল। ইবরাহিম আল্লাহর জন্য ইসমাইলকে কুরবানী দিতে নিয়ে গেলেন। শেষ মুহুর্তে আল্লাহ ইবরাহিমের কুরবানী কবুল করলেন এবং ইবরাহিমের ছুরির নিচ থেকে ইসমাইলকে সরিয়ে একটি দুম্বা দিয়ে দিলেন। এই হলো ছেলেবেলায় শোনা কুরবানীর গল্প।
আমাদের শঙ্কাটা ছিল, যদি ইসমাইলকেই কুরবানী দিতে হতো, তাহলে আমাদের বাবা-মাও আমাদের কুরবানী দিয়ে দিতো। তখন আমাদের কী হবে। অনেকে ক্ষেপাতো, তোকে তো সবাই অনেক ভালোবাসে, এবার তোকে কুরবানী দেবে। ভয়ে কুকড়ে যেতাম। ভয়ে ভয়ে দুয়েকবার আম্মাকে জিজ্ঞাসাও করেছি, আমাকে কুরবানী দিয়ে দেবে না তো? কুরবানী দেবে না, এটা নিশ্চিত হওয়ার পরই মেতে উঠতাম ঈদের আনন্দে।
দুই ঈদের দুইরকম আনন্দ। এক মাসের সিয়াম সাধনার পর আসা ঈদুল ফিতর মানে রোজার ঈদে নতুন নতুন জুতা-পোশাক মিলতো। ঈদুল আযহার মূল বাজেট কুরবানীর পশু কেনায়, তাই পোশাক-জুতার বাজেট থাকতো না। তবে ঈদুল আযহার মূল আনন্দ কুরবানীর গরু কেনা, কয়েকদিন লালন-পালন করা এবং কুরবানী দেয়ায়। সকালে ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ঈদগাহ ময়দানেই চলতো পশু জবাই। তারপর সবাই মিলে চলতো কাটাকুটি।
ছেলেবেলার সেই আনন্দ আর নেই। তবুও ঈদুল আযহা আসে ত্যাগের মহিমায় অপার আনন্দ নিয়ে। ত্যাগেও যে মহত্ব আছে, আনন্দ আছে ঈদুল আযহার চেতনা সেটাই। সামর্থ্য অনুযায়ী সবাই পশু কিনবেন, কুরবানি দেবেন। কুরবানীর পশুর মাংসের একটা অংশ দেয়া হয় দরিদ্রদের। তাতে সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় ঈদের আনন্দ। অন্তত একদিন সবার পাতে উঠে মাংস। অনেকের পাতে বছরের এই সময়টাতেই শুধু মাংসের দেখা মেলে।
কিন্তু এখন ঈদুল আযহায় ত্যাগের চেয়ে দেখনদারির চেতনাই বেশি। কার গরু কার চেয়ে বড়, কার গরুর দাম বেশি- এই নিয়ে চলে প্রতিযোগিতা। বেড়ে যায় ফ্রিজের বিক্রি। আর গরীব মানুষকে বঞ্চিত করে কুরবানীর মাংসে ভরে ওঠে সেই ফ্রিজ। গ্রামে একটা নির্দিষ্ট স্থানে কুরবানী হলেও শহরে পাড়া-মহল্লায়, রাস্তার মোড়ে, বাসার সামনে চলে অবাধে কুরবানী।
কুরবানী এলেই কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, কুরবানী নৃশংসতা, পশু হত্যা করা উচিত না ইত্যাদি ইত্যাদি। কদিন আগে বন্যার সময় অনেকে আওয়াজ তোলেন, কুরবানীর টাকায় বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে। বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর জন্য পশু কুরবানী দেয়াটা ইসলামের বিধান।
ইসলাম ধর্মে বিশ্বাস করলে সামর্থ্য অনুযায়ী আপনাকে কুরবানি দিতেই হবে। কুরবানির টাকায় বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করার সুযোগ নেই। বড় জোর যেটা করতে পারতেন, আপনার বাজেট যদি এক লাখ টাকা হতো, আপনি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনে, বাকি টাকা বন্যার্তদের দিতে পারেন। কিন্তু কুরবানি না দিয়ে পুরো টাকা বন্যার্তদের দিয়ে দেয়া ইসলাম অনুমোদন করবে না।
যারা নৃশংসতার কথা বলেন, তারা কি সবাই নিরামিষাশী, মাংস খান না? সেই পশুটাও তো নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও জবাই করা হয়। তবে এটা ঠিক, একটি নির্দিষ্ট স্থানে কুরবানী দেয়া উচিত। যাতে পুরো শহরেই রক্তের বন্যা বয়ে না যায়।
একজন মুসলমানের যেমন কুরবানী দেয়ার ধর্মীয় অধিকার আছে; তেমনি কুরবানী যাদের কাছে নৃশংসতা মনে হয় বা যিনি জবাইয়ের দৃশ্য বা রক্ত সইতে পারেন না; তারও অধিকার আছে না দেখার। তাই পুরো শহরকে জবাইখানা না বানিয়ে, নির্দিষ্ট স্থানে কুরবানি দিতে হবে।
আর পরিচ্ছন্নতা যে ঈমানের অঙ্গ, খেয়াল রাখতে হবে সেটিও। সৌদি আরবসহ কোনো দেশেই আপনি প্রকাশ্যে কুরবানি দেয়ার দৃশ্য দেখতে পাবেন না। খেয়াল রাখতে হবে, ত্যাগের মহিমাকে ম্লান করে আমরা যেন কুরবানীকে হত্যার মহোৎসব বানিয়ে না ফেলি। আর দরিদ্র মানুষের মাংসের ভাগ যেন ঠিকমত পায়। সম্ভব হলে চামড়া বিক্রির টাকা যেন বন্যার্তদের দেই। তাহলেই পরিপূর্ণ হবে ঈদুল আযহার ত্যাগের আনন্দ।
তবে এবার ঈদুল আযহা এসেছে আনন্দ বেদনার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে। দুদিন আগে প্রথমবারের মত টেস্ট ক্রিকেটে পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেশকে আনন্দে ভাসিয়েছে সাকিব-তামিমরা। সেদিন সকালেই আমাদের ছেড়ে গেছেন কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী আব্দুল জব্বার।
সারাদেশের মানুষ এবার সমানভাবে ঈদের প্রস্তুতি নিতে পারেনি। দেশের ৩৩ জেলার ৮০ লাখ মানুষ এবার বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছিল। বন্যার পানি নেমে গেলেও দুর্ভোগ নামেনি। বন্যার আসল দুর্ভোগ শুরু হয় আসলে পানি নামার পর।
কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অনেকের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাই বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ এখন ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করছে। বন্যার সময় দেশজুড়ে দুর্গতদের পাশে দাঁড়াতে সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগ ছিল।
পানি নেমে যাওয়ার পর বন্যা থেকে সবার নজর একটু সরে গেছে। কিন্তু ঘুড়ে দাড়ানোর এই সংগ্রামের সময়ই তাদের পাশে থাকা দরকার। অকাল বন্যায় ফসল হারানো হাওর এলাকায়ও এবার ঈদ পুরো আনন্দ নিয়ে আসেনি।
টেকনাফে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তেও চলছে মানবিক বিপর্যয়। গত সপ্তাহে রাখাইন রাজ্যে নতুন করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিধনযজ্ঞ শুরুর পর জান বাঁচাতে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ বাংলাদেশে ছুটে আসছে।
বাংলাদেশে সীমান্ত রক্ষীরা নাফ নদীতে রোহিঙ্গার স্রোত ঠেকানোর চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ বরাবরই রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করে আসছে। ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে আছেন প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা। এ বছর ইতিমধ্যেই কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।
সেনাবাহিনীর গুলি থেকে বাঁচতে নাফ নদী পেরুতে গিয়ে ট্রলারডুবিতে মারা গেছেন অন্তত ২৩ জন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে চলছে মানবিক বিপর্যয়। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছে।
জাতিসংঘসহ বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে চীনের উচিত রোহিঙ্গা সমস্যার একটি মানবিক রাজনৈতিক সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করা। কিন্তু যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই সমস্যা শিগগিরই সমাধান হবে, এমন কোনো লক্ষণ নেই।
কারণ সমস্যা সমাধানে যাদের আন্তরিকতা সবচেয়ে বেশি দরকার, সেই মিয়ানমার রয়েছে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে। নোবেল শান্তি বিজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার সমস্যার সমাধান চাইছে অস্ত্র দিয়ে, রোহিঙ্গাদের নির্মূল বা দেশত্যাগে বাধ্য করার কৌশলে।
তবে এবারের ঈদের আনন্দে বিষাদের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে রূপা খাতুন। সিরাজগঞ্জের দরিদ্র পরিবারের এই মেয়েটি বাংলাদেশের লাখো সংগ্রামী নারীর একজন। দরিদ্র হলেও তার স্বপ্ন ছিল বড়। আর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের অবলম্বন করেছিলেন শিক্ষাকে।
দরিদ্র পরিবারের গ্রামের একটি মেয়ের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সহজ নয়। বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র আরো বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু টিউশনি আর গার্মেন্টসে কাজ করে নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। বগুড়ার আযিযুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর শেষ করে ভর্তি হন ঢাকার আইডিয়াল ল কলেজে।
পাশাপাশি একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার পোস্টিং ছিল শেরপুরে। বৃহস্পতিবার অফিস শেষে শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে শেরপুর থেকে বগুড়া গিয়েছিলেন রূপা। পরীক্ষা শেষে রাতেই ফিরছিলেন কর্মস্থলে। বগুড়া থেকে ফেরার পথে এক পর্যায়ে বাসে একা হয়ে যায় মেয়েটি।
একা পেয়ে প্রথম বাসের সহকারী শামীম অশোভন প্রস্তাব দেয় রূপাকে। রূপা তার সাথে থাকা মোবাইল এবং টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলে। কিন্তু চলন্ত বাসেই ৫ পশু তাকে ধর্ষণ করে। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, মেরে রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে চলে যায়। ধর্ষণ ও হত্যার মত অপরাধ করেও নির্বিকার ৫ পশু স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিল।
পুলিশ অবশ্য ৫ জনকেই গ্রেপ্তার করেছে। মানুষের মতই দেখতে এই ৫ পশুর মানুষের মত নামও আছে- হাবিবুর রহমান, সফর আলী, শামীম, আকরাম ও জাহাঙ্গহীর। ছোঁয়া পরিবহনের যে বাসে উঠেছিলেন রূপা, সে বাসটির নাম ‘নিরাপদ’।
কিন্তু বাসটি আমার বোন রূপাকে নিরাপত্তা দিতে পারেনি। কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছি না বোন রূপার ছবিটা। এমন স্নিগ্ধ, সংগ্রামী মেয়েটিকে এভাবে মরতে হলো। সমাজ এতটাই নিরাপত্তাহীন আজ? নয়াদিল্লীতে চলন্ত বাসে নির্ভয়ার ধর্ষণের পর কেঁপে উঠেছিল ভারত।
ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ দেখি নির্বিকার। রূপার ঘাড় মটকানো লাশ পড়ে থাকে জঙ্গলে। আর আমরা খাচ্ছি-দাচ্ছি, আনন্দ করছি। নির্ভয়াকাণ্ডে ভারত কেঁপে উঠেছিল, আর আমরা শাহবাগে একটা মানববন্ধনও করতে পারিনি। আমাদের সব বিপ্লব ফেসবুকে।
এই নির্বিকারত্ব কি নিশ্চিত করতে পারবে আমাদের সবার নিরাপত্তা? বাসের সেই ৫ পশু দেখতে পুরুষের মত। তাই একজন পুরুষ হিসেবে সবার কাছে ক্ষমা চাই। আমাদের মা-বোন-কন্যা-বন্ধুকে নিরাপত্তা দিতে না পারার ব্যর্থতা আমার, আপনার, আমাদের সবার।
তবু ঈদ এসেছে। মুসলমানদের প্রধান দুই উৎসবের একটি ঈদুল আযহা। ঈদ আনন্দ বয়ে আনুক সবার ঘরে। তবে নিজেদের আনন্দের দিনে আমরা যেন ভুলে না যাই বানভাসিদের, পানিতে চিৎ হয়ে ভাসতে থাকা রোহিঙ্গা শিশুর ছবি যেন আমাদের ঘুমাতে না দেয়, হাসিখুশি রূপার ঘাড় মটকানো ছবি যেন আমাদের প্রতিবাদী করে, রূপার ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি থেকে যেন আমরা সরে না আসি।
তবুও সবার জন্য ঈদ মোবারক।