বাংলার দর্পন ডটকম >> আগামী সোমবার থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ শুরু হচ্ছে। সেদিন সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসবেন ইসি কর্মকর্তারা। অক্টোবরের প্রথমার্ধে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে শেষ হবে সংলাপ। এর মধ্যে চলমান সংলাপে অংশ নেবেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, পর্যবেক্ষক সংস্থা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা। এসব অংশীজন সংলাপে লিখিত সুপারিশ ও মতামত জানাবেন। পরে সে সব সুপারিশমালার প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত হবে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সুপারিশমালা চূড়ান্ত হবে। সে অনুযায়ী, একাদশ জাতীয় নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে মাঠে নামবে ইসি। শুরু হতে যাওয়া এ সংলাপের দিকে তাকিয়ে দেশ। কারণ ইতোমধ্যেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে নানা বিতর্ক ও মতভেদ চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় নির্বাচনকালীন কোনো সরকার দিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে সরকার। অবশ্য চাইলে ইসি নিজেও নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা পালন করতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বয়ং প্রধান নির্বাচন কমিশনার। অবশ্য সে জন্য ইসিকে নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড মাঠ তৈরির মতো কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে। কিন্তু ইসি বলেছে, তফসিল ঘোষণার আগে সেটি সম্ভব নয়। সেটিও অবশ্য মেনে নিতে নারাজ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। ফলে এই সংলাপ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা অন্তত চারটি বিষয়ে এই সংলাপকে ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, ইসির রোডম্যাপে বেশকিছু বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ভিন্নমত রয়েছে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও। বিতর্কগুলো হলো নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা না করা; নির্বাচনে সেনাবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে, নাকি মোতায়েন হবে; সীমানা পুনর্বিন্যাস কোন পদ্ধতিতে; এমনকি বিতর্ক রয়েছে নির্বাচনী আইন সংস্কার নিয়েও। এ ছাড়া নির্বাচনে পর্যবেক্ষক হিসেবে কারা অনুমতি পাবে, প্রিজাইডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হবে কাদের ও আমলারা অবসর নিয়েই নির্বাচন করতে পারবে কি না, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, নতুন নিবন্ধন ভোটকেন্দ্র, ইসির সক্ষমতা বাড়ানো ও সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি প্রসঙ্গগুলোও চ্যালেঞ্জ হবে ইসির জন্য। ফলে সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া ইসির সংলাপ নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন অংশীজনদের সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা প্রকাশ পাবে; তেমনি সেসব মত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসির স্বচ্ছতা প্রমাণের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০১৮ সালের ৩০ অক্টোবরের পর শুরু হবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় গণনা। ভোট গ্রহণের ৪০-৪৫ দিন আগে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করবে ইসি। সে অনুযায়ী, সোমবার থেকে এ সংলাপ শুরু হচ্ছে। সংলাপে পরামর্শ দেওয়ার সুবিধার্থে আমন্ত্রণের সঙ্গে নির্বাচনের ম্যানুয়েল (আইন ও বিধিমালার সংকলন), গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, নির্বাচনের বিভিন্ন বিধিমালা পাঠানো হয়েছে। কমিশন আশা করছে, এসব আইন ও বিধিমালা যুগোপযুগী করা এবং নির্বাচন ব্যবস্থা আরো গ্রহণযোগ্য করতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ মতামত দেবেন। ওই সব মতামতের মধ্যে যেগুলো গুরুত্বপূর্ণ তা আমলে নেবে কমিশন। অবশ্য সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনী রাজনীতিতে চলমান বিতর্কের অবসানের ব্যাপারে ইসি আশাবাদী বলে জানিয়েছেন ইসি সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় আছে, যা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব থাকে। কমিশন এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চায়। এর মাধ্যমে কমিশন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। নিশ্চয় সেখানে সমাধান মিলবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে এখন পর্যন্ত বড় কোনো পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়নি। তাই একাদশ সংসদ নির্বাচনই হবে ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কমিশনের সক্ষমতার ওপরই নির্ভর করছে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা। কারো প্রতি কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্ব না করে সংখ্যাগরিষ্ঠমতের ভিত্তিতে ইসিকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংলাপে উঠে আসা মতামত প্রতিষ্ঠায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জন করতে হবে। জনমনেও এ ধারণা বদ্ধমূল করতে হবে যে নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে সক্ষম। জন-আস্থা সৃষ্টি করতে পারলেই নির্বাচন কমিশনের সামনে থেকে সবচেয়ে বড় বাধাটি দূর হয়ে যাবে। বিশেষ করে ইসিকে নির্বাচনী মাঠের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। পেশিশক্তি ও কালো টাকার ব্যবহার বন্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ সবাইকে আস্থায় নিয়েই আগামী সংসদ নির্বাচন করতে হবে কমিশনকে।
এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, নির্বাচনী রোডম্যাপে ইসি সাতটি দফা দিয়েছে। এর মধ্যে একটি সংলাপ। সুতরাং, সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার সঙ্গে খোলামন নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কথা বলতে হবে। বিশেষ করে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। কারণ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার জন্য আইনশৃৃঙ্খলা পরিস্থিতি বড় জিনিস। নির্বাচনে কি হয়- না হয়, সেটি আমরা সবাই জানি। যেকোনো উপায়ে জয়লাভের প্রবণতা আমাদের দেশে বিদ্যমান। সবাই জিততে চায়। ইসি সে জন্যই কর্মপরিকল্পনা দেয়। বাস্তবায়ন করে। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সংলাপ শুরু হলে, আলোচনা হলে, অনেক কথা বেরিয়ে আসবে। সমাধানের পথও তৈরি হবে। তবে কোনো প্রকার বৈরিতা বা বিদ্বেষমূলক মনোভাব নিয়ে সংলাপে গেলে হবে না। সবাইকে খোলামনে একটি কার্যকর নির্বাচনের লক্ষ্য নিয়েই সংলাপে যেতে হবে। গণতন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। সবাই যদি দায়িত্বশীল হয়, তা হলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার আটকাতে হবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, সিইসি যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তাতে সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও সংলাপ অন্যতম। সুতরাং, সংলাপকে ইতিবাচক করতে ইসিকে উদ্যোগী হতে হবে। ইসিকে অবশ্যই নির্বাচনী পরিবেশ তৈরিতে উদ্যোগ নিতে হবে। আইনের কথা বলে এড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ নির্বাচন কমিশন যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ ইত্যাদি করার উদ্যোগ নিয়েছে, সেটি কিন্তু নির্বাচনী আইনে লেখা নেই। নির্বাচনী আইনে আছে, নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণা করবে এবং নির্বাচন পরিচালনা করবে। নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে তারা যদি রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহিতা আদায় করতে পারে, তবে নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করার জন্য সরকারকে কেন বলতে পারবে না। এই বিশেষজ্ঞ সংলাপে উঠে আসা মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচনকালীন কিছু বিতর্ক সমাধানের আহ্বান জানান।
যে কোনো সংকট থেকে মুক্তির উপায় বের করতে সংলাপের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। সংলাপ ছাড়া সমাধানের পথ নেই। নির্বাচন কমিশনের অনুষ্ঠেয় সংলাপ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে। কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করা। এ লক্ষ্যে কমিশনের অনুষ্ঠেয় সংলাপ থেকে এমন কিছু সমাধানের পথ বেরোবে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখবে। তিনি আরো বলেন, সংলাপে যারা অংশ নেবেন, তাদের অর্থাৎ সব পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে। বাস্তবসম্মত দাবি জানাতে হবে। ধনুভঙ্গপণ নিয়ে থাকলে হবে না। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ছাড় দিতে হবে। সবার সঙ্গে সংলাপ শেষে সেখান থেকে উঠে আসা পরামর্শগুলোর মধ্যে যতটুকু প্রাসঙ্গিক, নির্বাচন কমিশন ততটুকু বাস্তবায়ন করবে বলে আমরা আশা করছি।